পারতপক্ষে সরাসরি কেউ কারও নাম নেন না। প্রাক্তনকে এক বার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বর্তমান সম্পর্কে লিখতে হলে কী লিখবেন? স্মিত হেসে জবাব ছিল, ‘‘সাদা পাতা ছেড়ে আসব!’’
বর্তমান আবার বিরোধী আসনে থাকার সময়ে পূর্বসূরিকে ছেড়ে কথা বলেননি কোনও দিন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনার পরে ‘খুনি বুদ্ধে’র মুণ্ডপাত করে পোস্টার ছেয়ে দিয়েছিলেন রাজ্য জুড়ে। পাঁচ বছর আগে প্রথম বার ক্ষমতায় এসে প্রাক্তনকে শপথগ্রহণে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রাজভবনে সে বারই দু’জনের শেষ মুখোমুখি দেখা।
রাজ্যের নাম বদলের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা সোমবার হঠাৎ এক বিন্দুতে এনে ফেলল দু’জনকে!
নিজের মতের পক্ষে যুক্তি সাজাতে গিয়ে বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শরণ নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! দীর্ঘ ১৭ বছর আগে বিধানসভায় বুদ্ধবাবু কী বলেছিলেন, দস্তাবেজ ঘেঁটে উদ্ধৃত করলেন। বোঝাতে চাইলেন, পশ্চিমবঙ্গকে ‘বাংলা’ করতে তাঁর পূর্বসূরি যে কথা বলেছিলেন, তিনিও সে পথের পথিক! বাংলার রাজনীতি, তৃণমূল এবং সিপিএম, বুদ্ধ এবং মমতা— সব নিরিখেই বিরলতম নজির বিধানসভায় নথিভুক্ত হয়ে থাকল সোমবার!
রাজ্যের নাম সব ভাষাতেই ‘পশ্চিমবঙ্গ’ করার জন্য ১৯৯৯ সালের ২০ জুলাই প্রস্তাব এসেছিল বিধানসভায়। আলোচনার মধ্যেই ঠিক হয়, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলা নামটা ভাল। সহমতের ভিত্তিতে তৎকালীন শাসক বাম ও বিরোধী কংগ্রেস-তৃণমূলের তরফে প্রস্তাবের উপরে সংশোধনী আনা হয়। সেই সহমতের মনোভাব এবং বাংলার পক্ষে সওয়ালই যে তাঁর পছন্দের, সেটাই এ দিন বোঝাতে চেয়েছেন মমতা। তখনই তাঁর হাতিয়ার হয়েছেন বুদ্ধবাবু।
বিধানসভায় নাম বদল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মমতা এ দিন পুরনো নথি উদ্ধৃত করে বলেন, ‘‘১৯৯৯ সালে ১৮৫ ধারায় প্রস্তাবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ভাষাতত্ত্ব ও ইতিহাসের উপরে দাঁড়িয়ে রাজ্যের নাম বাংলা করতে চাই। অনেক বিশিষ্ট জনও এটা চেয়েছিলেন। ইঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের চেয়ে বাংলাই ভাল!’’ তার পরেই মমতার আরও সংযোজন, ‘‘এটা তো আগের মুখ্যমন্ত্রীই বলে গিয়েছিলেন।’’ যে সময়ের কথা, তখন অবশ্য বুদ্ধবাবু উপ-মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসুর সরকারে। তবু তথ্যগত এই বিতর্ক বাদ দেওয়াই যায়! বুদ্ধবাবুর মতকে মমতা উদ্ধৃত করছেন নিজের পক্ষে ব্যবহার করার জন্য, এমন নজির কে কবে দেখেছে!
শুধু এখানেই থামেননি মুখ্যমন্ত্রী। বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীর উদ্দেশে এ দিন মমতা বলেছেন, ‘‘সিপিএমের সরকার তো চেষ্টা করেছিল। কাজটা হয়নি, সেটা আলাদা কথা। দিল্লিরই উচিত ছিল, এগুলো করে দেওয়া। কিন্তু আগের সরকার চেষ্টা করেছিল।’’ বাম সরকার চেষ্টা করেছিল বলেই এখন সুজনবাবুদের আপত্তি করা উচিত নয়, বোঝাতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সুজনবাবুও আপত্তি করেননি। তবে প্রশ্ন করেছেন, একই রাজ্যের নাম বাংলায় ‘বাংলা’, ইংরেজিতে ‘বেঙ্গল’ এবং হিন্দিতে ‘বঙ্গাল’ কী ভাবে হয়? সুজনবাবুর কথায়, ‘‘আমি বাংলায় সুজন বলে ইংরেজিতে তো গুডম্যান চক্রবর্তী লিখি না। বেচারাম মান্নাকে ইংরেজিতে কেউ সেল্সম্যান মান্না বলে না!’’ মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এই যুক্তি শোনেননি। আলাদা আলাদা ভাষায় আলাদা আলাদা নামের বিরোধিতা করে বামেদের আনা সংশোধনী ১৮৯-৩১ ভোটে খারিজ হয়ে গিয়েছে। আর মূল প্রস্তাব পাশের সময়ে কংগ্রেস ওয়াক আউট করে বাইরে, বাম বিধায়কেরাও সংশোধনীর পরে প্রায় সকলেই বেরিয়ে গিয়েছেন। সেই অর্থে ২৯৪ জনের বিধানসভায় সর্বসম্মত প্রস্তাব হয়নি এ বার।
মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু সভার বাইরে বলতে ভোলেননি, ‘‘সুনীলদা (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) বেঁচে থাকলে খুশি হতেন। বুদ্ধবাবুর কথা তো বললাম। আমরা এখন থেকেই ‘বাংলা’ লেখা শুরু করব।’’
দেরি না করে বিকেলেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে ফোন করে মমতা অনুরোধ করেছেন, এ বার যেন কেন্দ্র প্রস্তাবটা ঠান্ডা ঘরে ফেলে না রাখে। বর্তমানের সহৃদয়তা নিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মুখ খোলেননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ এক সিপিএম নেতা বলছেন, ‘‘নিশ্চয়ই ‘বাংলা’য় সূর্য অন্য দিকে উঠেছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy