Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মেয়াদ বাড়িয়ে জোড়াতাপ্পি অধ্যক্ষ-সঙ্কটে

দীর্ঘদিন ধরে পদ খালি। কিন্তু বহু কলেজে স্থায়ী অধ্যক্ষ মিলছে না। তাই এ বার বর্তমান বা বিদায়ী অধ্যক্ষদের চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে অধ্যক্ষের আকাল সামাল দিতে চাইছে রাজ্য সরকার।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:১২
Share: Save:

দীর্ঘদিন ধরে পদ খালি। কিন্তু বহু কলেজে স্থায়ী অধ্যক্ষ মিলছে না। তাই এ বার বর্তমান বা বিদায়ী অধ্যক্ষদের চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে অধ্যক্ষের আকাল সামাল দিতে চাইছে রাজ্য সরকার।

রাজ্যে উচ্চশিক্ষার যে কার্যত মাথাহীন দশা চলছে, খোদ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও বিভিন্ন সময়ে তা স্বীকার করেছেন। মাথাহীন দশা বলতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন স্থায়ী উপাচার্য নেই, একই ভাবে বহু কলেজে নেই স্থায়ী অধ্যক্ষ। রাজ্যের প্রায় ২০০টি কলেজই চলছে স্থায়ী অধ্যক্ষ ছাড়া। সরকার বারে বারেই জানিয়েছে, তারা টিচার-ইনচার্জদের দিয়ে কলেজ চালানোর বিরোধী। কিন্তু কী ভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়, সেই সমাধানসূত্র মেলেনি।

শিক্ষামন্ত্রী মনে করেন, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে কলেজ চালানোটা আসলে স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ আটকে রাখা। এই নিয়ম তাঁরা আর চলতে দেবেন না। মঙ্গলবার কলেজ অ্যান্ড ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল (কুটাব)-এর সমাবেশে পার্থবাবু বলেন, ‘‘টিচার-ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ) ব্যাপারটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ করার চেষ্টা চালাচ্ছি।’’ স্থায়ী অধ্যক্ষ না-পেলে পুরনো অধ্যক্ষ অবসর নেওয়ার পরেও প্রয়োজনে দু’তিন মাস মেয়াদ বাড়িয়ে তাঁকে কাজ চালিয়ে যেতে বলা হবে। যখন নতুন স্থায়ী অধ্যক্ষ আসবেন, তাঁকে কলেজের দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিয়ে তবেই ছুটি পাবেন তিনি।

দু’তিন মাসেও যদি স্থায়ী অধ্যক্ষ না-মেলে, তখন কী হবে? ধোঁয়াশা রয়েই গিয়েছে। শিক্ষা দফতর সূত্রে বলা হয়, ওই সব ক্ষেত্রে পুরনো অধ্যক্ষের মেয়াদ আরও কিছু দিন বাড়িয়ে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হবে। তবে এ ব্যাপারে কোনও নীতি চূড়ান্ত হয়নি।

স্থায়ী উপাচার্যের সমস্যা জিইয়ে রাখা হচ্ছে শিক্ষা মহলের একাংশের অভিযোগ। এখন প্রশ্ন উঠছে, বিদায়ী অধ্যক্ষের মেয়াদ বাড়িয়ে স্থায়ী অধ্যক্ষের সমস্যাটি টেনে যাওয়া হচ্ছে কেন? এই জোড়াতালির ভবিষ্যৎ কী? জবাব মিলছে না। স্থায়ী অধ্যক্ষ না-থাকায় বহু কলেজে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে বলে শিক্ষা শিবিরের অভিযোগ। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষদের দিয়ে কলেজ চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন কলেজ-কর্তৃপক্ষ। স্থায়ী অধ্যক্ষ না-থাকায় থমকে আছে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ। এমনকী পড়ুয়াদের বিভিন্ন কাজও হচ্ছে না স্থায়ী অধ্যক্ষের সই না-মেলায়। বহু সরকারি কলেজেও একই অবস্থা।

এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের প্রশ্ন, অধ্যক্ষের ১৪৯টি শূন্য পদে নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ৫০ শতাংশ পদ পূরণের মতো আবেদনও তো আসেনি। শিক্ষকেরা যেখানে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসছেন না, সেখানে শিক্ষামন্ত্রী কী ভাবে স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগের আশ্বাস দিচ্ছেন?

শিক্ষামন্ত্রী জানাচ্ছেন, শিক্ষকেরা যাতে স্থায়ী অধ্যক্ষ-পদে আগ্রহী হন, সেই চেষ্টা চালাচ্ছে শিক্ষা দফতর। কোন কলেজে কত শিক্ষক আছেন আর কত শিক্ষক প্রয়োজন, তার একটা হিসেব করতে হবে। কিন্তু স্থায়ী অধ্যক্ষ কবে নিয়োগ করা হবে? দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি শিক্ষামন্ত্রী। স্থায়ী অধ্যক্ষের পদে প্রার্থীর অভাব কেন?

কলেজে কলেজে হাঙ্গামা, অধ্যক্ষদের উপরে হামলাই এর কারণ বলে শিক্ষাজগতের একাংশের অভিমত। শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুটা-র সাধারণ সম্পাদক শ্রুতিনাথ প্রহরাজ বলেন, ‘‘বিভিন্ন কলেজে অধ্যক্ষদের যে-লাঞ্ছনা চলছে, ওই পদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলার পক্ষে সেটাই যথেষ্ট। পরিস্থিতি যা, তাতে যে-কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের অধ্যাপকই ওই পদে আবেদন করতে ভয় পাবেন।’’ বিকাশ ভবনের কর্তাদের একাংশের বক্তব্যেও এর সমর্থন মিলছে। তাঁরা বলছেন, অধ্যক্ষ হলে বাড়তি আর্থিক প্রাপ্তি যৎসামান্য। কিন্তু ঝক্কি-ঝামেলা অনেক বেশি। কলেজের প্রশাসন ও পঠনপাঠনের যাবতীয় দায়দায়িত্ব সামলানোর সঙ্গে সঙ্গে উটকো ঝুটঝামেলা ঘাড়ে এসে পড়ে। তাই ওই পদে বসতে আগ্রহী শিক্ষক-অধ্যাপক মিলছে না।

স্থায়ী অধ্যক্ষের অভাবের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক-ঘাটতিও বহু কলেজের জ্বলন্ত সমস্যা। আংশিক সময়ের শিক্ষকদেরও অভাব-অভিযোগ বিস্তর। কুটাব-এর সাধারণ সম্পাদক গৌরাঙ্গ দেবনাথ জানান, এই মূহূর্তে ৫৪১৭ জন আংশিক সময়ের শিক্ষক রয়েছেন। স্থায়ী শিক্ষকদের মতোই দায়িত্ব সামলান তাঁরা। পরীক্ষার খাতা দেখা থেকে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া— সবই তাঁদের করতে হয় ন্যূনতম সাম্মানিকের বিনিময়ে। স্থায়ী শিক্ষকদের সমান দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলেও উপযুক্ত বেতন বা সম্মান পান না তাঁরা। কলেজের পরিচালন সমিতি বা কাউন্সিলেও তাঁদের সদস্য করা হয় না বলে অভিযোগ।

শিক্ষামন্ত্রী এ দিন জানান, যদি আংশিক সময়ের শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয় বা নির্দিষ্ট কাজের বেশি খাটানো হয়, সংশ্লিষ্ট কলেজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ‘‘আমি এই ধরনের অনেক অভিযোগ শুনেছি। শুনে অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, কলেজের প্রধানেরা আংশিক সময়ের শিক্ষকদের অমানবিক ভাবে ক্লাস নেওয়ানোর চেষ্টা করছেন কী করে! এটা মানবো না। নিয়মে যা আছে, তার অতিরিক্ত কিছুই হবে না,’’ বলেন শিক্ষামন্ত্রী। সেই সঙ্গেই তিনি জানান, অনেক আংশিক সময়ের শিক্ষকের যোগ্যতা নেই। কিন্তু তাঁরা কাজ করছেন। তাঁদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, ‘‘এটা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র। যোগ্যতা থাকলে তবেই দাবি করা যায়। নইলে কিন্তু আন্দোলন করেও কোনও লাভ হবে না। অবহেলিতই থেকে যাবেন।’’

কুটাব-এর দাবিসনদের প্রেক্ষিতে পার্থবাবুর আশ্বাস, ‘‘কলেজ সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক নিয়োগের সময় ১০ শতাংশ পদে নিয়োগ হবে আংশিক সময়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকেই।’’ কোনও আংশিক সময়ের শিক্ষক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে তাঁর চিকিত্সার বন্দোবস্ত করা যায় কি না, সরকার সেটাও ভেবে দেখছে। তাঁদের প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং মেডিক্যাল লিভ নিয়েও চিন্তাভাবনা করছে সরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Westbengal Ministry
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE