বোর্ড দিয়ে যায় চেনা!
মাত্র চার বছরে দার্জিলিং পাহাড়ের জন্য পাঁচটি জনজাতি উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেছে রাজ্য সরকার। শুক্রবার সিংমারির সরকারি মঞ্চ থেকে রাই এবং লিম্বুদের জন্য আরও দু’টি বোর্ড গঠনের কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং তাতেও শেষ নয়! পাহাড়ের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আর্জি মেনে আরও একটি বোর্ড গঠন নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। প্রতিটি নতুন বোর্ডকে বছরে গড়ে ১০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই লেপচা বোর্ডকে ৮৬ কোটি, তামাঙ্গ বোর্ডকে ২০ কোটি, মঙ্গর বোর্ডকে ৫ কোটি এবং ভুটিয়া ও শেরপা বোর্ডকে ১০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে পাহাড়ের পাঁচটি বোর্ডকে রাজ্য ১৩১ কোটি টাকা দিয়েছে।
আর এই বোর্ড-বন্যাতেই শীতের মরসুমেও গরম দার্জিলিং! বোর্ডের সংখ্যা যত বাড়ছে, তত সরব হচ্ছেন মোর্চা নেতৃত্ব। দলের সভাপতি বিমল গুরুঙ্গের কথায়, ‘‘পাহাড়ে বিভাজনের রাজনীতি করছে রাজ্য সরকার। গত অগস্টে আমরা মুখ্যমন্ত্রীকে পাহাড়ে আমন্ত্রণ জানালাম। আর উনি এসে ভুটিয়া বোর্ড গঠন করে চলে গেলেন!’’ এ ভাবে বোর্ড গঠন করে মমতা আসলে বিভাজনের রাজনীতি করছেন, অভিযোগ গুরুঙ্গের।
বিতর্ক, বরাদ্দ বা ব্যয় যা-ই হোক না কেন, একের পর এক বোর্ড গঠন কিন্তু পাহাড়ে অন্য আমেজ এনে দিয়েছে। এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা শোনার পরে সভায় এক জনের মন্তব্য, ‘‘এত দিন পাশাপাশি ছিলাম, খোঁজই রাখতাম না কে কোন জনজাতি! মুখ্যমন্ত্রী সেটাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন।’’ কেউ কেউ মজা করে পাশের লোকের কাছে খোঁজ নিচ্ছিলেন, তাঁর পাড়ায় লেপচা কারা, ভুটিয়াই বা কারা!
পাহাড়ে তৃণমূল-বিরোধীরা বলছেন, এ সব আসলে মোর্চার ভোট ভাগ করে নিজের পায়ের তলায় জমি শক্ত করার রাজনীতি। এক মোর্চা সমর্থক বেশ রাগী গলায় বললেন, ‘‘তা হলে এ বার সমতলেও উন্নয়ন পর্ষদ হোক!’’ সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে আর এক জনের ফোড়ন, ‘‘সাহাদের জন্য একটা, বন্দ্যোপাধ্যায়দের জন্য আর একটা— বোর্ডের তা হলে অভাব হবে না!’’
তৃণমূলের কর্মিসভায় ঢুকছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুক্রবার কোচবিহার রবীন্দ্র ভবনে। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।
প্রায় একই যুক্তি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর গলাতেও। বাগডোগরায় এক সভায় এসে তিনি এ দিন বলেন, ‘‘পাহাড়ে লেপচা, তামাঙ্গ, শেরপারা সংখ্যায় অল্প সংখ্যক হয়েও যদি উন্নয়ন পর্ষদ পেতে পারে, তা হলে সমতলে রাজবংশী ও নমশূদ্রদের নিয়ে উন্নয়ন পর্ষদ হবে না কেন?’’ এই দাবি নিয়ে খুব শীঘ্রই তাঁরা আন্দোলনে নামবেন, জানিয়ে রাখলেন অধীর। বললেন, ‘‘উত্তরবঙ্গে আড়াই কোটি রাজবংশী ও দেড় কোটি নমশূদ্র মানুষ রয়েছেন।’’
ঘটনা হল, পরপর বোর্ড গঠনের হাওয়ায় কপালে চিন্তার ভাঁজ গুরুঙ্গের। যে কারণে তিনি বেশ ক্ষোভের সুরে বলেছেন, ‘‘বোর্ড গড়ে হয়তো কিছু লোককে কাছে পাওয়া যেতে পারে, সবাইকে নয়।’’ কিন্তু মোর্চা সূত্রেই খবর, লেপচা বোর্ড গড়ার পর কালিম্পং বিধানসভা এলাকায় মোর্চার কর্তৃত্ব অনেকটাই কমে যায়। কারণ, ওই এলাকার বাসিন্দাদের প্রায় অর্ধেকই লেপচা জনগোষ্ঠীর। কার্শিয়াং, দার্জিলিং বিধানসভাতেও ১০-১৫ শতাংশ লেপচা জনগোষ্ঠী রয়েছে। তার উপরে হরকা বাহাদুর ছেত্রী দল ছাড়ায় কালিম্পঙে তার প্রভাব পড়ছে। উপরন্তু, মঙ্গর, শেরপা, ভুটিয়া, তামাঙ্গ সম্প্রদায়ের ভোটাররাও বেশ কিছু এলাকায় হার-জিতের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক হওয়ার ক্ষমতা রাখেন। দলগত ভাবে তৃণমূল পাহাড়ে এখনও তেমন শক্তিশালী নয়। তবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বড় অংশের সমর্থন পেলে ফল ওলটপালট হয়ে যেতে পারে— আশঙ্কা মোর্চার অন্দরেই।
এই অবস্থায় ‘বোর্ড-রাজনীতি’র ধাক্কা সামলাতে পাহাড়ে তাঁর বিরোধী দলগুলির একাংশকে কাছে টানতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন গুরুঙ্গ। এ দিনই ভারতীয় গোর্খা পরিসঙ্ঘের নেতা আর মোক্তান মোর্চায় যোগ দিয়েছেন। মোর্চা সূত্রের খবর, গোর্খা লিগ, জিএনএলএফ, সিপিআরএমের একাংশকেও দলে টানার চেষ্টা চলছে।
তবে মুখ্যমন্ত্রী এ সবে আমল দিতে রাজি নন। তাঁর দাবি, ‘‘আমি দিনের পর দিন পাহাড়ে আসছি। এখনকার নানা সম্প্রদায়ের মানুষেরা এসে তাঁদের দুঃখকষ্টের কথা বলেন। এত দুর্দশা চোখে দেখা যায় না। ঘর নেই, বাড়ি নেই। এ সব দেখে তো বসে থাকতে পারি না। এর মধ্যে রাজনীতির কি আছে?’’
সহ প্রতিবেদন: রেজা প্রধান
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy