রাজ্যে সাপের বিষ সংগ্রহ বন্ধ করে দিয়েছে বন দফতর। এই অবস্থায় সাপে-কাটা রোগীদের জন্য যে-ওষুধ অর্থাৎ ‘অ্যান্টিভেনাম’ তৈরি হচ্ছে, তাতে রাজ্যের বিষধর সাপেদের বিষ কার্যত থাকছেই না। ফলে সেই ওষুধ পশ্চিমবঙ্গে সাপের কামড় খাওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে তেমন কার্যকর হচ্ছে না। পরিস্থিতি এমনই সঙ্গিন হয়ে যে, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সর্পদংশনের চিকিৎসায় যুক্ত বিশেষজ্ঞেরা।
চিকিৎসক-গবেষকেরা জানাচ্ছেন, সাপে সাপে মিল থাকতে পারে। কিন্তু সাপে-সাপে ফারাকও বিস্তর। মূল ফারাকটা বিষের তীব্রতায়। বিভিন্ন প্রজাতির সাপের মধ্যে বিষ-গত প্রভেদ তো আছেই। এমনকী স্থানভেদে একই প্রজাতির সাপের বিষে তীব্রতা হয় নানা মাত্রার। মানুষের শরীরে তারা ক্ষতিও করে নানা ভাবে। বিষের এই রকমফেরের জেরে বিষে বিষক্ষয়ের দাওয়াইও কমজোরি হয়ে পড়ে। প্রতিষেধক তৈরির জন্য তাই চাই হরেক কিসিমের বিষ। সাপে-কাটার কার্যকর ওষুধ তৈরির জন্য রাজ্যে সাপের বিষ সংগ্রহ কেন্দ্র খুলতে বন দফতরের দ্বারস্থ হয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা।
বছর দশেক আগেও এ রাজ্যে সাপে-কাটার প্রাথমিক জীবনদায়ী ওষুধ অ্যান্টিস্নেক ভেনম সিরাম (এএসভি) তৈরি হতো। কিন্তু বিষ সংগ্রহে নানান অনিয়ম জাঁকিয়ে বসায় সাপের বিষ সংগ্রহের কাজটাই নিষিদ্ধ করে দেয় সরকার। সাপে-কাটার ওষুধে ব্যবহারের জন্য বাংলার সাপের বিষের উপাদান জরুরি হওয়া সত্ত্বেও সেই থেকে বিষ সংগ্রহই বন্ধ।
সর্পদংশনের চিকিৎসা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, চিকিৎসক দয়ালবন্ধু মজুমদার বলেন, ‘‘এএসভি-তে বাংলার সাপের বিষের উপাদান না-থাকায় ওষুধের কার্যকারিতা ফিকে হয়ে যাচ্ছে।’’ ১০০ মিনিটের মধ্যে ১০ ভায়াল এএসভি পড়লে সর্পদংশনে মৃত্যুর সম্ভাবনা শূন্য। অথচ ডেবরার সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারবাবু থেকে ক্যানিংয়ের গণস্বাস্থ্য আন্দোলনে যুক্ত কর্মীদের অভিজ্ঞতা, সময়মতো ২০-৩০ ভায়াল এএসভি পড়া সত্ত্বেও ইদানীং রোগীকে বাঁচাতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। রোজই ১০-১৫ জন সর্পদষ্ট রোগীর ডায়ালিসিস হচ্ছে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে।
‘‘গুজরাত বা দক্ষিণ ভারতের হাসপাতালগুলোয় এএসভি-র কার্যকারিতা কিছুটা বেশি। কারণ সেখানে স্থানীয় সাপের বিষের উপাদান যথাযথ মাত্রাতেই যুক্ত করা হয় ওষুধে। সেখানে ডায়ালিসিসের প্রয়োজন হয় কমই,’’ বলছেন দয়ালবন্ধুবাবু।
বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, রাজ্যভেদে সাপে-কাটা রোগীর শরীরে বিষের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন-ভিন্ন হয়। আমেরিকার টক্সিন রিভিউ জার্নালের তথ্য বলছে: কেরল-তামিলনাডুর চন্দ্রবোড়ার ছোবলে রক্তক্ষরণ বেশি। কিন্তু বাংলার চন্দ্রবোড়া কামড়ালে কিডনি বেহাল হয়ে পড়তে পারে। গবেষণায় প্রকাশ, বর্ধমানে ১০ কিলোমিটার অন্তর কেউটের বিষের চরিত্র পাল্টে যায়। জলপাইগুড়ির গোখরোর বিষ কোষে পচন ধরালে হুগলি-বর্ধমানের গোখরোর বিষে বেহাল হয় স্নায়ুতন্ত্র।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের ভেনাম টাস্ক ফোর্সের সদস্য, শারীরবিদ্যার অধ্যাপক অ্যান্টনি গোমসের কথায়, ‘‘সব এলাকার বিষ মিলিয়ে ওষুধ তৈরি হলে ডাক্তারদের আত্মবিশ্বাস বাড়ত। সেই জন্য অতীতে জাতীয় ভেনাম ব্যাঙ্ক তৈরির ব্যাপারে অনেক আলোচনা হয়েছে।’’
বর্ধমানের মেমারি-মালপাড়ার সাপুড়েদের কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক বিষ সংগ্রহ কেন্দ্র গড়তে দৌড়ঝাঁপ করছেন সরীসৃপবিদ বিশাল সাঁতরা। ওই কেন্দ্র গড়ার জন্য বছর দুয়েক আগে বন দফতরে তাঁর অনুরোধও জমা পড়েছে। ‘‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে,’’ আশ্বাস দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্য বনপাল প্রদীপ ব্যাস। এই বিষয়ে সই সংগ্রহ করে বনকর্তাদের অনুরোধ-উপরোধ জানাতে আপাতত মাথা খুঁড়ছেন ডাক্তার, বিষ-গবেষক থেকে গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy