Advertisement
০৪ মে ২০২৪

লিট্ল মাস্টারের ‘মাস্টারি’ জঙ্গলমহলের স্কুলেও

সচিন বাইশ গজে থাকলে রানের রোশনাই ছড়ায় এখনও। আর স্কুলে ‘লিটল মাস্টারে’র বরাদ্দ অর্থ গেলে শিক্ষার আলো বাড়ে। ‘সচিনের স্কুলে’র অবদান খুঁজল আনন্দবাজারসচিন বাইশ গজে থাকলে রানের রোশনাই ছড়ায় এখনও। আর স্কুলে ‘লিটল মাস্টারে’র বরাদ্দ অর্থ গেলে শিক্ষার আলো বাড়ে। ‘সচিনের স্কুলে’র অবদান খুঁজল আনন্দবাজার

সচিনের সাংসদ তহবিলের টাকায় তৈরি হয়েছে নারায়ণগড়ের স্বর্ণময়ী শাসমল শিক্ষা নিকেতনের এই ভবন। নিজস্ব চিত্র

সচিনের সাংসদ তহবিলের টাকায় তৈরি হয়েছে নারায়ণগড়ের স্বর্ণময়ী শাসমল শিক্ষা নিকেতনের এই ভবন। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৮ ০২:৫৪
Share: Save:

দক্ষিণ মুম্বইয়ের এলাকা। তেমন পরিচিত নয়। এলাকার নাম লোয়ার সেউরি বললে কেউ চিনবেন না তেমন। ওই এলাকারই একটা স্কুলের নাম গুরু গোবিন্দসিংহ তেগবাহাদুর হাইস্কুল।
উত্তর কাশ্মীরের কুপওয়ারার একটি জনপদের নাম দ্রুগমুলা। সেখানে আছে ইম্পিরিয়াল এডুকেশন ইনস্টিটিউট।
পশ্চিম মেদিনীপুরে রয়েছে গোবিন্দপুর-মকরামপুর স্বর্ণময়ী শাসমল শিক্ষা নিকেতন। ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুর-১ ব্লকে একটি স্কুলের নাম আশুই পল্লিমঙ্গল বিদ্যাপীঠ। এই চার স্কুলের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু যোগসূত্র খুঁজে পাওয়াটা অসম্ভব নয়। সেই যোগসূত্রের নাম ‘লিট্ল মাস্টার’ সচিন তেন্ডুলকর। মুম্বই, কাশ্মীর, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামের স্কুলগুলোতেও সচিন ‘মাস্টারি’ করেছেন। সেই অর্থে সরাসরি শিক্ষাদান করেননি। কিন্তু পড়ুয়ারা যাতে শিক্ষা পায় তার ব্যবস্থা করেছেন। স্কুলের নতুন ক্লাসরুম গড়তে, পরীক্ষাগার তৈরিতে, ছাত্রাবাস নির্মাণে টাকা দিয়েছেন।
সাংসদেরা অনেকেই তাঁদের তহবিলের টাকা শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করেন। তাতে নতুনত্ব নেই। রাজ্যসভার সাংসদ হওয়ায় সচিনের পদক্ষেপে রাজ্যের সীমানা টানা ছিল না। শিক্ষার জন্য অর্থদানের বিষয়টা সচিনের কাছেও নতুন নয়। তিনি তাঁর সাংসদ তহবিলের ৩০ কোটি টাকার মধ্যে সাত কোটি ৪০ লক্ষ টাকা শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করেছেন। তার মানে আরও কয়েকটি রাজ্যের স্কুল তাঁর বরাদ্দ পেয়ে থাকতে পারেন। ব্যক্তিজীবনেও সচিন ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন। অনেকেই জানেন, সচিন পিছিয়ে পড়া পরিবারের ২০০টি বাচ্চার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন।
তাহলে সচিন নতুন কি করেছেন? সচিন অর্থবরাদ্দ করে একটা গোটা এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়ানোর মূল দীপশিখাটির উজ্জ্বল থাকার ব্যবস্থা করেছেন। যেমন দ্রুগমুলার ইম্পিরিয়াল স্কুল। ওই এলাকার একমাত্র স্কুল এটি। এলাকায় সমস্যা প্রচুর। তার ওপরে আছে জঙ্গিদের সমস্যা। তাদের দমন করতে সেনার অভিযান। এই লেখাটি তৈরির সময়ে স্কুলের ফেসবুকে একটা বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির জন্য মঙ্গলবার স্কুলের পঠনপাঠন বন্ধ রাখা হচ্ছে। কারণ সেনা অভিযানে ১২ জঙ্গির মৃত্যুতে উদ্ভূত পরিস্থিতি। সহশিক্ষামূলক এই স্কুলটি নতুন করে গড়তে সাহায্য করেছেন সচিন। দিয়েছেন ৪০ লক্ষ টাকা। যা দিয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এই স্কুলের নতুন ক্লাসরুম হয়েছে, চারটি গবেষণাগার হয়েছে। স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা হাজার।
আর এখানেই দ্রুগমুলার স্কুলের সঙ্গে মিলে যায় ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুরের আশুই পল্লিমঙ্গল বিদ্যাপীঠ। সচিন এই স্কুলের আদিবাসী ছাত্রাবাস তৈরির জন্য ২০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছেন। ১৫ লক্ষ টাকা স্কুল পেয়ে গিয়েছে। বাকি টাকাও জেলা প্রশাসনের কাছে এসে গিয়েছে। আগামী মাসে ছাত্রাবাসটি উদ্বোধন করা হতে পারে। এই নীরস তথ্যের বাইরের বিভিন্ন বিষয়গুলো দেখা যাক। আশুই স্কুলটি জঙ্গলমহলে অবস্থিত। স্কুলের একদিকে সুবর্ণরেখা। তারপর ওডিশার বারিপদা। আরেকদিকে ঝাড়খণ্ড। এই রাজ্যের জামশুলি স্কুলের কিছুটা দূরে। একসময়ে মাওবাদীদের প্রভাবে ত্রস্ত ছিল এলাকা। স্কুলের কথা বলছিলেন প্রধানশিক্ষক তরুণকুমার চক্রবর্তী। ২০১৫ সালে যখন স্কুলে যোগ দেন তখন ক্লাসঘরের অভাব। বেঞ্চ ছিল না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছেলেমেয়েদের ডেকে আনতে হতো। এখন সেই স্কুলের পড়ুয়ার সংখ্যা ১১২৯। ছেলেদের হস্টেলে থাকে ৭০ জন। সচিনের টাকায় তৈরি হস্টেলে চলে যাবে আবাসিক ছাত্ররা। মেয়েদের জন্য হস্টেলেরও চেষ্টা করা হচ্ছে।
স্কুলে খেলাধুলোর চর্চাও যথেষ্ট। মেয়েরা কন্যাশ্রী ফুটবলে এলাকায় চ্যাম্পিয়ান। ছেলেরা ক্রিকেট খেলে। তবে জঙ্গলমহলে ক্রিকেটের টুর্নামেন্ট না হওয়ায় তাদের যোগ্যতামান পরীক্ষা করা যায়নি। স্কুলের কিন্তু নিজস্ব মাঠ নেই। কাছের এক খাস জমিতে খেলে মেয়েরা। নিজস্ব মাঠের জন্য চেষ্টা করছে স্কুল। এই রকম একটা এলাকার স্কুলকে ‘মাস্টার ব্লাস্টার’ অর্থ সাহায্য করছেন জানলে প্রাথমিক ভাবে যে প্রতিক্রিয়া দেখতে পাওয়ার কথা তা-ই দেখেছিলেন তরুণবাবু। অবিশ্বাস। লোকে বিশ্বাস করতে পারেননি কলকাতা বা রাজধানীর কাছেপিঠের কোনও জেলার স্কুল নয়, জঙ্গলমহলের স্কুলকে টাকা দিচ্ছেন সচিন।
এখন অবশ্য গ্রামবাসীরা গর্বিত। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং গ্রামবাসীরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ছাত্রাবাসটা করা হবে ‘লিটল মাস্টারে’র নামে। স্কুলে বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রের নামে ব্লক রয়েছে। এবার সচিনের নামেও হবে। ছাত্রাবাসে রাখা হবে সচিনের তৈলচিত্র। সবংয়ের এক শিল্পীকে দিয়ে সেটা আঁকানো হচ্ছে। স্কুলের ভাল মাঠ নেই। ক্রিকেটের সরঞ্জাম নেই। পরীক্ষাগার নেই। সচিন যদি স্কুলের আসেন কী চাইবেন? প্রধানশিক্ষক তরুণবাবু বলেন, ‘‘চাইবার তো অনেক কিছুই আছে। কিন্তু আরও তো কত স্কুল আছে। তাদেরও তো কত কিছু নেই।’’
স্বর্ণময়ী শাসমল শিক্ষা নিকেতনের অবস্থাটা কমবেশি একই রকম। পরিবেশগত সমস্যা ততটা নেই। কিন্তু পরিকাঠামো এবং শিক্ষার মানে খামতি রয়েছে, সেটা মানেন স্কুলের প্রধানশিক্ষক উত্তমকুমার মহান্তি। তাঁর আবেদনেই এই স্কুলটিকে ৭৬ লক্ষ ২১ হাজার টাকা বরাদ্দ করেন সচিন। যা দিয়ে স্কুল সারাই, মেয়েদের কমন রুম, পরীক্ষাগার-সহ বিভিন্ন পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু সচিন-পূর্ব যুগে? প্রশ্ন করলে এখনও খারাপ লাগে উত্তমবাবুর। বলেন, ‘‘স্কুলের ঝরঝরে অবস্থা, ক্লাসরুম নেই। ছাদ দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ে। ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে খারাপ লাগত। কিছুই তো দিতে পারছি না ওদের।’’ সেই অবস্থার উন্নতি হয়েছে। হাজারখানেক পড়ুয়ার শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা গিয়েছে কিছুটা। আরও কিছু অর্থের প্রয়োজন। তার জন্য আর সচিনের কাছে আবেদন করবেন না বলে জানিয়েছেন উত্তমবাবু। তবে তিনি চান, স্কুলের খুদেগুলোকে সচিন পরামর্শ দিন। মুম্বইয়ের সেউরি স্কুলের খুদেদের পরামর্শ দিয়েছিলেন সচিন। সেই পরামর্শ সচিনোচিত, ‘‘যখন মজা করার তখন জমিয়ে মজা করো। কিন্তু পড়ার সময়ে মন দিয়ে পড়ো।’’
শুধু পরামর্শ চেয়ে কাজ শেষ করতে চান না উত্তমবাবু। তিনি চান এলাকার খুদেগুলোকে স্কুলমুখী করতে। স্কুলের প্রতি এলাকার স্বচ্ছল, শিক্ষিত পরিবারগুলোর আস্থা ফিরেছে। কিন্তু এখনও তফসিলি জাতি, উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার বহু পরিবারকে স্কুলমুখী করা প্রয়োজন বলে মনে করেন উত্তমবাবু। এখনও বহু পরিবারের প্রথম প্রজন্ম সবে স্কুলের চৌকাঠে পা দিয়েছে। তিনি এই পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েদের স্কুলে দেখতে চান নিয়মিত।
উত্তমবাবু বললেন, ‘‘সকলকে শিক্ষার আঙিনায় আনতে পারলেই কিন্তু সচিন স্যারের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হবে। তিনি আমাদের ওপরে আস্থা রেখেছেন কিন্তু।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE