Advertisement
০৪ মে ২০২৪

মুখোশ খুলে দেখাতে হল, ছৌ নাচছেন মেয়েরা

পুরুলিয়ার মালডি গ্রামের শ্যামলী চৌধুরী এখন বাংলা প্রথম বর্ষের ছাত্রী। জ্ঞান হওয়া থেকে তিনি দেখে এসেছেন, বাবা-কাকা সব্বাই ব্যস্ত ছৌ নাচ নিয়ে। তাই নেশাটা ধরে যায় শৈশবেই।

অনুশীলনে শ্যামলী চৌধুরী (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।

অনুশীলনে শ্যামলী চৌধুরী (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।

অন্বেষা দত্ত
অন্বেষা দত্ত শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৮ ০৫:০৩
Share: Save:

মেয়েটাকে ‘নাচিয়ে’ টাকা কামাবি! বিয়ে হবে না পরে— প্রতিবেশীদের কাছ থেকে এমন সব কথাই ধেয়ে এসেছিল মেয়ের বাবার কাছে।

বাবা দমেননি। মেয়ে তো নয়ই। তিন-চার কেজি ওজনের মুখোশ, আর ভারী পোশাক পরে লাফানো। অসম্ভব শারীরিক পরিশ্রম। কিন্তু ওটাই চুম্বকের মতো টানত মেয়েকে— ছৌ নাচ।

সেই মেয়ে অর্থাৎ পুরুলিয়ার মালডি গ্রামের শ্যামলী চৌধুরী এখন বাংলা প্রথম বর্ষের ছাত্রী। জ্ঞান হওয়া থেকে তিনি দেখে এসেছেন, বাবা-কাকা সব্বাই ব্যস্ত ছৌ নাচ নিয়ে। তাই নেশাটা ধরে যায় শৈশবেই।

ছৌ নাচে মহিলাদের দেখা যেত না, এমন নয়। কিন্তু তাঁদের অংশগ্রহণ নিয়ে এক রকমের আপত্তি ছিল। সে আপত্তি উড়িয়ে এগিয়ে এসেছেন শ্যামলী, তাঁর দিদি, তাঁদের গ্রামের আরও বেশ কয়েক জন মেয়ে। রীতিমতো প্রশিক্ষণ নিয়ে যাঁরা গড়ে তুলেছেন দল। সে দলে বাদ্যকারেরা পুরুষ হলেও বাকি সবাই মেয়ে। মেয়েদের নিয়ে ছৌ-এর দলে উৎসাহ দিয়েছেন বাবা জগন্নাথ চৌধুরী। যিনি নিজেও প্রবীণ ছৌ শিল্পী। মেয়েদের প্রশিক্ষণে সাহায্য করেছেন মধুমিতা পাল। যিনি ভরতনাট্যমের ছাত্রী হলেও নিজ আগ্রহে ছৌ শিখেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনিও আলাদা করে মেয়েদের নিয়ে ছৌ-এর দল তৈরি করেছেন। শহরে ছৌ-কে জনপ্রিয় করে তুলতে চান তাঁরা। শ্যামলীদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে কলকাতার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও।

পুরুলিয়ায় এই দলটিকে দেখে এগিয়ে এসেছে আরও মেয়ে। মাত্র ১৪-১৫ বছর বয়সেই শুরু করে দিয়েছেন অনুষ্ঠান। দলের সংখ্যাও বেড়েছে। তবে প্রথমে এসেও অনেকে আবার পিছিয়ে গিয়েছে। শ্যামলীরা থামেননি। এখন গ্রাম পেরিয়ে শহরের মঞ্চে তাঁদের নাচ দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। শ্যামলী বলেন, ‘‘এটা আমার স্বপ্ন। পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ চালিয়ে যেতে চাই। এমএ-র পরে ছৌ নিয়ে পিএইচডি করতে চাই।’’ ভবিষ্যতে ছৌ শেখানোর জন্য স্কুল খোলারও ইচ্ছে আছে।

বাবা জগন্নাথ বলেন, ‘‘লোকে অনেক কথাই বলে। কান দিই না। আগে শিক্ষাদীক্ষা কম ছিল। অনেকে আটকে যেত। এখন মেয়েরা পড়াশোনা করছে। সময় পাল্টেছে। ওরা ভালমন্দ বোঝে। ওদের যা ইচ্ছে, সেটাই করবে।’’ আর এই আশ্বাস পেয়ে শ্যামলীর পাশে এক এক করে সরলা মূড়া, করুণা মাহাতোরা চলে এসেছে। পিরিয়ড্‌সের সময়ে এত পরিশ্রমে অসুবিধা হয় না? শ্যামলীর বক্তব্য, ‘‘মুখোশ আর পোশাক পরার পরে কিছু মাথায় থাকে না। তখন নাচটাই সব।’’

পুরুলিয়ায় এখন ছৌ-এর অন্তত তিন-চারটি দল রয়েছে মেয়েদের। গ্রামের লোকজনের সামনে মেয়েদের দল ছৌ নাচছে, অনেকে নাকি প্রথমে বিশ্বাসই করেননি। অনুষ্ঠান দেখার পরেও। এ নাচে মঞ্চে মুখোশ খোলা রীতিবিরুদ্ধ। শেষমেশ সে রীতি ভেঙে শ্যামলীদের প্রমাণ করতে হয়েছে, সত্যিই মেয়েরা নেচেছেন।

শুধু পৌরাণিক কাহিনি নয়, ছৌ-এর মাধ্যমে এখন সামাজিক বার্তাও দিচ্ছেন ওঁরা। কখনও বাল্যবিবাহ রোধের বার্তা। কখনও থিম হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের গল্প। কিন্তু উদ্দীপনার পাশাপাশি আক্ষেপও আছে মেয়েদের। যে পরিমাণ পরিশ্রম , তার সমান পয়সা হাতে আসে কই! ছৌ-এর মুখোশের দামই চার-পাঁচ হাজার। সব মিলিয়ে পোশাকে লাগে ১০-১২ হাজার টাকা। সে অনুপাতে অর্থ হাতে আসে না বলে দাবি শ্যামলীর।

তবু স্বপ্নটা একগুঁয়ে। কিছুতেই ছাড়ব না ছৌ — পণ এই মেয়ের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Purulia Chhau Dance Traditional Dance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE