Advertisement
০৩ মে ২০২৪
সারদা কমিশন

দায় এড়াতে কোর্টই এখন ভরসা রাজ্যের

টাকা নেই, রাজনৈতিক ফায়দাও ক্রমশ কমছে। এই অবস্থায় সারদা কমিশনের ভবিষ্যৎ কী হবে? পাশ কাটিয়ে বলটা আদালতের আঙিনাতেই ফেলতে চলেছে রাজ্য। আগামী ২২ অক্টোবর, বুধবার সারদা কমিশনের মেয়াদ ফুরনোর কথা। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশিকা না-আসা পর্যন্ত কমিশন যেন নতুন করে আর কোনও কাজে হাত না দেয়।

অনুপ চট্টোপাধ্যায় ও দেবজিৎ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১১
Share: Save:

টাকা নেই, রাজনৈতিক ফায়দাও ক্রমশ কমছে। এই অবস্থায় সারদা কমিশনের ভবিষ্যৎ কী হবে? পাশ কাটিয়ে বলটা আদালতের আঙিনাতেই ফেলতে চলেছে রাজ্য। আগামী ২২ অক্টোবর, বুধবার সারদা কমিশনের মেয়াদ ফুরনোর কথা। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশিকা না-আসা পর্যন্ত কমিশন যেন নতুন করে আর কোনও কাজে হাত না দেয়।

২০১৩-এর এপ্রিল মাসে সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারদা কমিশন গড়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। ঠিক হয়, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শ্যামলকুমার সেনের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন মূলত তিনটি কাজ করবে
(১) সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত মূল দোষীদের চিহ্নিত করবে।
(২) আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেবে।
(৩) সারদার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা বিক্রি করবে। গোড়ায় কমিশনের মেয়াদ রাখা হয়েছিল ছ’মাস। পরে এক বছরের জন্য তা বাড়ানো হয়। সেই মেয়াদই বুধবার শেষ হচ্ছে। কমিশন সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই প্রায় সাড়ে ১২ লক্ষ আবেদনকারীর মধ্যে ৫ লক্ষ মানুষকে সরকারি কোষাগার থেকে টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।

কেন কমিশনের মেয়াদ আর বাড়ানো হচ্ছে না? মাসখানেক আগেই প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে একটি বৈঠকে অর্থ দফতর মৌখিক ভাবে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, কমিশনকে দেওয়ার মতো আর টাকা তাদের হাতে নেই। এর পরে, দিন দশেক আগে বিষয়টি নিয়ে নবান্নে বৈঠক করেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই বৈঠকে প্রশ্ন ওঠে, অর্থ দফতর যদি টাকা না-দেয় তা হলে কী ভাবে টাকা ফেরানো হবে লক্ষ লক্ষ আমানতকারীর? আর যদি টাকার অভাবে সরকার কমিশনের মেয়াদ না বাড়ায়, তা হলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়াই বা কী ভাবে সামালানো হবে? নবান্নের খবর, কোন পথে হাঁটলে সাপও মরবে অথচ লাঠি ভাঙবে না, তার খোঁজ করতে বলা হয় আইন দফতরকে।

তৃণমূলের এক বিধায়ক জানাচ্ছেন, “গত শুক্রবার তৃণমূল ভবনে দলীয় সদস্যদের এক সভাতেও মুখ্যমন্ত্রী এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভাবা হয়েছিল, সারদার সম্পত্তি বিক্রি করে বাকি টাকা ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কারণে তা করা যাচ্ছে না। সরকারেরও টাকা নেই।” মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাব জেনেই আইন দফতর বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসে।

আইন দফতর সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে আদালতের কোর্টেই বল ফেলা হবে বলে ঠিক হয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠছিল, সুপ্রিম কোর্ট যেখানে কমিশনের কাজকর্ম বা ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে নিষেধ আরোপ করেনি, সেখানে কীসের ভিত্তিতে আদালতে যাবে রাজ্য? নবান্ন সূত্রের খবর, কাজটা সহজ করে দেয় কমিশনেরই একটি চিঠি।

সেপ্টেম্বর মাসের ৪ তারিখ রাজ্য সরকারের কাছে কমিশন একটি চিঠি পাঠায়। তাতে মূলত তিনটি বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল।

(১) আমানতকারীদের নামের তালিকা ‘আপ-টু-ডেট’ করতে পারেনি বিধাননগর কমিশনারেট। এর জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাজে অসুবিধা হচ্ছে।

(২) এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) জমি বাজেয়াপ্ত করার কাজে ঢুকে পড়ায় কমিশনের কাজে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। কমিশন এ ব্যাপারে কী করবে তা জানানো হোক।

(৩) সারদার যে সব সম্পত্তি কমিশন বাজেয়াপ্ত করেছে, ইডি-র জন্য তা বিক্রিবাটা করতে পারছে না কমিশন। এ ব্যাপারে কমিশনের আইনি অবস্থান কী হবে তা জানানো হোক।

এই চিঠিটি হাতিয়ার করেই আদালতের যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করেছে রাজ্য। রাজ্য সরকারের তরফে স্বরাষ্ট্র দফতরের কমিশনার এ মাসের ১৫ তারিখ সারদা কমিশনকে একটি চিঠি দিয়েছেন। তাতে লেখা হয়েছে, কমিশনের ‘ইচ্ছা অনুযায়ী’ই রাজ্য সরকার কলকাতা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুতরাং আপাতত কমিশনের আর কোনও কাজকর্ম না করাই বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ পরোক্ষে বলে দেওয়া হলো যে, আদালতের নির্দেশ না আসা পর্যন্ত কমিশনের কাজকর্ম বন্ধ রাখা হোক।

বিরোধীরা অভিযোগ করছেন, রাজ্যবাসীর ক্ষোভ চাপা দিতেই গত বছর ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সরকার চেয়েছিল ক্ষতিপূরণের টোপ দিয়ে সারদা-অসন্তোষকে সামালাতে। কিন্তু এখন সিবিআই তদন্তে যে ভাবে তৃণমূল নেতা ও শাসক দলের ঘনিষ্ঠ লোকজনের নাম জড়াচ্ছে, তাতে মানুষের কাছে দলীয় ভাবমূর্তি রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ফলে সরকারের কাছে কমিশনের উপযোগিতাও ক্রমশ কমছে। সেই কারণেই অর্থ দফতর টাকা আর ঢালতে চাইছে না। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের সায় না থাকলে অর্থ দফতর ‘টাকা দেব না’ বলতে পারে?

নতুন করে মেয়াদ বাড়ানো না হলে এমনিতেই বুধবার, ২২ অক্টোবর বন্ধ হওয়ার কথা সারদা কমিশনের। কমিশন সূত্রের খবর, সোমবার বিকেল অবধিও মেয়াদ বাড়ানোর কোনও সরকারি নির্দেশ আসেনি। কমিশনের চেয়ারম্যান এ দিন জানান, চিঠি না এলে ২২ তারিখের পর তিনি আর কমিশনে আসবেন না। এখন আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্য আনুষ্ঠানিক ভাবে তালা না ঝুলিয়েই কমিশনকে কার্যত তার পাট চুকোতে বলে দিল।

বিরোধীরা দাবি করছেন, সারদা মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী কিছু জনসভায় বলেছিলেন, ‘এ বার ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত দেবে সিবিআই। সরকার দেবে না।’ বিরোধীদের মত, মুখ্যমন্ত্রী ওই বক্তব্যে রাজনীতির আড়ালে সারসত্যটাই বলেছিলেন। এখন সেই পথটাই খুঁজছে রাজ্য সরকার।

প্রশাসনের অন্দরেই একাংশ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সিঙ্গুর মামলায় অনেকটা একই ভাবে অনিচ্ছুক চাষিদের ক্ষোভ প্রশমনের রাস্তা নিয়েছিল শাসক দল। সিঙ্গুর-অর্ডিন্যান্স আদালতের এক্তিয়ারে যাওয়ার পরে বিভিন্ন সমাবেশে সেই প্রসঙ্গ টেনে তৃণমূল নেতৃত্ব বলেছিলেন, রাজ্য সরকার অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফিরিয়ে দিতেই চায়। কিন্তু মামলা আদালতে বিচারাধীন থাকায় তা দেওয়া যাচ্ছে না। বিরোধীদের অনুমান, সারদার ক্ষেত্রেও একই পথে হাঁটতে চলেছে রাজ্য। কমিশনের চিঠিকে ঢাল করে তারা দেখাতে চাইবে, কমিশন আইনি প্রশ্ন তোলাতে বাধ্য হয়েই তাদের আদালতে যেতে হলো।

অন্য দিকে, কমিশন সূত্রের বক্তব্য, রাজ্যকে চিঠি না দিয়ে তাঁদের কোনও উপায় ছিল না। কারণ, সিবিআই সারদা তদন্ত হাতে নেওয়ার পরে অপরাধীদের চিহ্নিত করার কাজটা মূলত তারাই করছিল। আবার সারদার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার দায়িত্ব নিয়েছিল ইডি। এমতাবস্থায় ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরানো ছাড়া কমিশনের হাতে কাজ তেমন থাকছিল না। কিন্তু অর্থ দফতর যে আর টাকা দেবে না, সে খবর তাঁরা ঠারেঠোরে আগেই পেয়েছিলেন বলে জানাচ্ছেন কমিশনের এক সদস্য। নবান্নের এক আধিকারিকেরও দাবি, “সিবিআই এবং ইডি ঢোকার পরে কমিশন কার্যত নিধিরাম সর্দারে পরিণত হয়েছে।”

কিন্তু কমিশন বন্ধ হয়ে গেলে তার চূড়ান্ত রিপোর্টের কী হবে? এর কোনও জবাব দেননি কমিশনের চেয়ারম্যান। তবে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা পড়াই নিয়ম। কিন্তু মেয়াদ না বাড়লে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই রিপোর্ট তৈরি করা কার্যত অসম্ভব। যদিও নবান্ন সূত্রের দাবি, কমিশন আগেই জানত ২২ অক্টোবর তাদের মেয়াদ শেষ হবে। তা হলে তারা চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করে রাখেনি কেন? কমিশনের সদস্যরা কি ধরেই নিয়েছিলেন যে কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হবে? নবান্নের এক আধিকারিকের দাবি, “গত দেড় বছর ধরে কমিশন কাজ করছে। কমিশন মনে করলে এই সময়ের মধ্যেই তাদের কাজ শেষ করতে পারত। এর দায় রাজ্যের নয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE