Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

সোলেমানকে ক্ষতিপূরণ কেন, ক্ষোভ মাখড়ায়

হামলায় ক্ষতিপূরণ হামলাকারীদেরই! মাখড়া-কাণ্ডে রাজ্য সরকারের ক্ষতিপূরণের ঘোষণায় উঠে আসছে এমনই গুরুতর অভিযোগ। রবিবার তা নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ল মাখড়াও। মাখড়াকে দু’দিক থেকে ঘিরে হামলা চালিয়েছিল বহিরাগত দুষ্কৃতীরা। যাতে প্রাণ যায় গ্রামেরই তরতাজা এক যুবকের। অথচ মাখড়া-কাণ্ডে রাজ্য সরকারের ক্ষতিপূরণ প্রাপকের তালিকায় নাম রয়েছে শেখ সোলেমানেরও। যিনি সংঘর্ষের দিন দুবরাজপুর থেকে কী করতে মাখড়ায় গিয়েছিলেন, তার সদুত্তর এখনও মেলেনি।

রবিবার শেখ সোলেমানের স্ত্রীকে চেক দিচ্ছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) নিবিল ঈশ্বরারি। দুবরাজপুরে। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত।

রবিবার শেখ সোলেমানের স্ত্রীকে চেক দিচ্ছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) নিবিল ঈশ্বরারি। দুবরাজপুরে। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৮
Share: Save:

হামলায় ক্ষতিপূরণ হামলাকারীদেরই!

মাখড়া-কাণ্ডে রাজ্য সরকারের ক্ষতিপূরণের ঘোষণায় উঠে আসছে এমনই গুরুতর অভিযোগ। রবিবার তা নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ল মাখড়াও।

মাখড়াকে দু’দিক থেকে ঘিরে হামলা চালিয়েছিল বহিরাগত দুষ্কৃতীরা। যাতে প্রাণ যায় গ্রামেরই তরতাজা এক যুবকের। অথচ মাখড়া-কাণ্ডে রাজ্য সরকারের ক্ষতিপূরণ প্রাপকের তালিকায় নাম রয়েছে শেখ সোলেমানেরও। যিনি সংঘর্ষের দিন দুবরাজপুর থেকে কী করতে মাখড়ায় গিয়েছিলেন, তার সদুত্তর এখনও মেলেনি। ক্ষতিপূরণের এমন সিদ্ধান্ত জেনেই ক্ষোভে ফুঁসছেন নিহত তৌসিফের বৃদ্ধ বাবা শেখ সওকত আলি। তাঁর কথায়, “ছেলের মৃত্যুর কোনও ক্ষতিপূরণ হয় না। তা সত্ত্বেও সব দিক বিবেচনা করে প্রশাসনের এই সহায়তা ফিরিয়ে দিইনি। অথচ যাঁরা আমার নিরীহ ছেলেটাকে গুলি করে খুন করল, সেই সোলেমানদেরও রাজ্য সরকার আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে! বুঝতে পারছি না, এটা ঠিক কীসের ক্ষতিপূরণ!” সরকারের এই পদক্ষেপ খুনি-দুষ্কৃতীদেরই প্রশ্রয় দিল, বলেও অভিযোগ তৌসিফের বাবার।

গত ২৪ অক্টোবর বীরভূমের পাড়ুই থানার চৌমণ্ডলপুরে গ্রামে বোমা উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশ আক্রান্ত হয়। তার দু’দিন পরেই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি থাকা সত্ত্বেও দুষ্কৃতীরা চৌমণ্ডলপুর লাগোয়া মাখড়া গ্রামে হামলা করে। বিজেপির অভিযোগ, হাতছাড়া হয়ে যাওয়া গ্রাম পুনর্দখল করতে তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতীরা ওই অভিযানে সামিল হয়েছিল। যে ঘটনায় প্রথমে স্থানীয় বিজেপি কর্মী তৌসিফ আলি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গ্রামবাসীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে খুন হন শেখ সোলেমান। আর পিটিয়ে খুন করা হয় মোজাম্মেল শেখ নামে মাখড়ার এক তৃণমূল কর্মীকে।

কিন্তু সংঘর্ষের সময় পাশের ব্লক দুবরাজপুরের সালুঞ্চি গ্রামের তৃণমূল কর্মী সোলেমান সেখানে কী করছিলেন? তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের দাবি, “সোলেমান বেড়াতে গিয়েছিলেন।” বিজেপির মতে ওটা হাস্যকর যুক্তি। তাদের দাবি, তৃণমূলের ইলামবাজার ব্লক সভাপতি জাফারুল ইসলামের নির্দেশেই ওই দিন মাখড়া পুনর্দখলে যোগ দিয়েছিল সোলেমান ও আরও কিছু যুবক। একাধিক অভিযোগে পুলিশের খাতায় যাদের নাম আছে।

নিহত তৌসিফের বাবা যে প্রশ্ন তুলেছেন, একই কথা বলছেন বিরোধী নেতারাও। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রশ্ন, “আক্রমণকারীদের আবার ক্ষতিপূরণ কী? তাদের তো হাজতে থাকার কথা! বাড়িতে যে ডাকাতি করতে এল, তাদের দলকে না ধরে আপনি কি ক্ষতিপূরণ দিতে যাবেন?” সূর্যবাবুর বক্তব্য, পুলিশের সামনেই তাদের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে যে সব নিরীহ গ্রামবাসীর ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছিল, প্রশাসনিক সাহায্যে তাদের বাড়ি মেরামত করে ঘরে ফেরানোর দাবি তুলেছে বামেরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ত্রাণ তহবিল থেকে সাহায্য বা মাওবাদী-সহ জঙ্গি হানায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পে ক্ষতিপূরণের সংস্থান আছে। কিন্তু রাজনৈতিক সংঘর্ষে ক্ষতিপূরণ দিতে গেলে ২০১১ থেকে রাজ্যে খুন হওয়া প্রায় দু’শোর কাছাকাছি বাম কর্মী-সমর্থক কী দোষ করলেন, সেই প্রশ্নও উঠবে। সূর্যবাবু মনে করিয়ে দেন, নন্দীগ্রামে সংঘর্ষের পরে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। সরকারি উদ্যোগ ছিল না।

প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া আবার মন্তব্য করেছেন, “বিষমদে মৃত্যু আবগারি দফতরের ব্যর্থতা ছিল। মাখড়ায় সংঘর্ষে মৃত্যু পুলিশের ব্যর্থতা। বিষমদ-কাণ্ডের মতোই মাখড়ায় দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশের ব্যর্থতাকেই স্বীকৃতি দিলেন!”

মাখড়া-কাণ্ডে বিজেপি অবশ্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল। তাই এ যাত্রায় তাদের অবস্থান কিছুটা ভিন্ন। পরিস্থিতি বুঝে এই ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতা অনুব্রতকেই এক হাত নিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। কোচবিহারে এ দিন তিনি বলেন, “নিহতদের পরিবারকে ১০ লক্ষ এবং আহতদের দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যাদের ঘরবাড়ি পুড়েছে বা ভেঙেছে, সমস্ত ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা দিতে হবে অনুব্রত মণ্ডলের সম্পত্তি নিলাম করে। পাপ করবেন ওঁরা আর সরকারি কোষাগার থেকে টাকা দেওয়ার খেসারত দেবেন মানুষ, তা হয় না!” সেই সঙ্গে মাখড়াবাসীদের উদ্দেশে রাহুলবাবুর পরামর্শ, “রাজ্য সরকারের প্রধান রাজ্যপাল। তাই সরকারি আধিকারিক ক্ষতিপূরণ দিলে তা গ্রহণ করুন।”


মাখড়ায় চেক হাতে তৌসিফের বাবা। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

ক্ষতিপূরণ দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত যে রীতিমতো প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিল, দলের অন্দরে তা কবুল করছেন তৃণমূল নেতৃত্বও। প্রকাশ্যে কেউই মুখ খুলছেন না। তবে দলের এক শীর্ষস্থানীয় নেতার বক্তব্য, “একটা ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দিতে গেলে তো নিহত সবাইকেই দিতে হবে। তখন আর বাছবিচার কী করে সম্ভব?” বিজেপির দাবির সূত্র ধরে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন রাজ্যপাল। মুখ্যমন্ত্রী তা মেনে নিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলেও পরিস্থিতি তাতে আরও জটিল হয়েছে বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতাদের একাংশ।

মাখড়ায় গিয়ে এ দিনই নিহত তৌসিফ ও মোজাম্মেলের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের চেক দেন জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী। তিনি চেক-বিতর্ক নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “আমরা রাজ্য সরকারের নির্দেশ পালন করেছি।” দুবরাজপুরের সালুঞ্চিতে গিয়ে সোলেমানের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের চেক দিয়েছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) নিবিল ঈশ্বরারী।

মাখড়াবাসীদের একটি অংশের অভিযোগ, গ্রামছাড়া মোজাম্মেলদের ফেরাতেই বহিরাগতদের এনে তৃণমূল পুনর্দখলের হামলা চালায়। হামলাকারীদের প্রথম সারিতেই ছিল সোলেমান, লাল বাস্কে (জখম হয়ে বর্ধমান মেডিক্যালে)। এই ঘটনায় পুলিশ শুধু দুবরাজপুরের সালুঞ্চি ও খণ্ডগ্রাম থেকেই দশ জনেরও বেশি তৃণমূল কর্মীকে আটক করেছিল। পরে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাই ওই দিনের ঘটনার ক্ষতিপূরণ কেন দুবরাজপুরের ‘খুনি’দের বাড়িতে যাবে, তা নিয়েই ক্ষুব্ধ মাখড়াবাসী। শেখ সোহেল, আবু রায়হানরা বলছেন, “তৃণমূলের গুন্ডাদের একটা দল গ্রামে ঢুকে সন্ত্রাস চালাল। তৌসিফটা মরে গেল। প্রশাসন ওঁর পরিবারের পাশে দাঁড়াল ঠিকই। কিন্তু একই সঙ্গে খুনিদের পাশেও দাঁড়ানোটা কি অন্যায় নয়?” নিহত সোলেমানকে অবশ্য নিরীহ বলেই দাবি করেছেন তাঁর স্ত্রী আনসারা বিবি। তাঁর দাবি, “আমার স্বামী এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন। ঠিকমতো তদন্ত হলেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।” ক্ষতিপূরণ পেয়ে রাজ্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে হতদরিদ্র ওই পরিবার। পাঁচ ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসারে সোলেমানই একমাত্র রোজগেরে ছিলেন।

মাখড়ায় এখনও আতঙ্কে রয়েছে নিহত মোজাম্মেলের পরিবার। তাঁর স্ত্রী তফিজা বিবি বলেন, “তৃণমূল করার জন্য বিজেপির লোকেরা আমার স্বামীকে খুন করল। তার পর থেকেই আতঙ্কে রয়েছি। কখন কী হয়। গ্রামের অবস্থা ভাল নয়।” তবে ক্ষতিপূরণ পেয়ে খুশি তফিজা। প্রশাসনের কাছে একটি চাকরির আর্জিও জানিয়েছেন তিনি। তফিজার বক্তব্যকে হাতিয়ার করেই তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “ঝোলা থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে! আমরা গোড়া থেকেই বলে আসছি, বিজেপি রাজ্যে অশান্তি বাধাতে চাইছে। মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে উন্নয়নের কর্মকাণ্ড চলছে, তাতে বাধা দিতেই বিজেপির মতো বিরোধীদের প্ররোচনায় দুষ্কৃতীরা বোমা বাঁধছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE