E-Paper

ভোটের আগে আশঙ্কায় অশান্তির আঁতুড়ঘর

এ রাজ্যে রাজনৈতিক হানাহানির ইতিহাস বেশ পুরনো। যে সব জায়গায় সন্ত্রাস হত, সেগুলির কী অবস্থা, নতুনই বা কোন অঞ্চল তপ্ত হল, ফিরে দেখা পঞ্চায়েত ভোটের আগে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৩ ০৬:৪০
Representational image of Panchayat Polls.

নির্বাচনী সন্ত্রাস: ডোমকলে ২০০৮-এর ভোটে পুলিশ জানিয়েছিল, বোমা-গুলিতে মারা গিয়েছিলেন ১৪ জন। প্রতীকী ছবি।

নির্বাচনী সন্ত্রাসের কথা উঠতেই মুর্শিদাবাদের ডোমকলের মুলুক মণ্ডল হাত জোড় করে বললেন, ‘‘আমাকে যা ইচ্ছা জিজ্ঞেস করুন। আমার বোনকে এ নিয়ে কিছু বলবেন না।’’ ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে সেই বালিকা দেখেছিল, কী ভাবে তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা মা পরের পর বোমার আঘাতে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। সেই ভয়টা এখনও ফিরে ফিরে আসে।

তার পরে ডোমকলকে এলাকাবাসীরা নাম দিয়েছিলেন, ‘বোমকল’। ডোমকলই শুধু নয়, নির্বাচনী সন্ত্রাসের কথা উঠলে ভয় ফিরে আসে কোচবিহারের ভেটাগুড়ি, পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম, খেজুরি, হুগলির আরামবাগ, পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট, রায়না-সহ রাজ্যের একাধিক জায়গায়। এই সব এলাকায় বিভিন্ন নির্বাচনের দিন বা তার আগে-পরে বোমা-গুলিতে মৃত্যু বা অঙ্গহানির ঘটনা অনেকেই জানেন। তার থেকেও বড় কথা, ভোটের সন্ত্রাসের ধাক্কায় অনেকেরই জীবনের গতিপথ বদলে গিয়েছে। সে হিসাব করা কঠিন।

ডোমকলে ২০০৮-এর ভোটে পুলিশ জানিয়েছিল, বোমা-গুলিতে মারা গিয়েছিলেন ১৪ জন। কিন্তু এক পুলিশ আধিকারিকই পরে জানান, গোপনে অনেক দেহ মাটি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মৃতের সংখ্যা ঠিক কত, সে বিষয়ে এখনও তাই ধন্দ রয়েছে। ভোট-সন্ত্রাসে পিতৃহারা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘‘মানসিক ও অর্থনৈতিক ভাবে বহু পরিবার সে ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘সেই সন্ত্রাসই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে তৃণমূল।’’ তৃণমূলের ব্লক সভাপতি হাজিকুল ইসলামের কথায়, ‘‘বাম আমলেই ওই কাণ্ড ঘটেছিল। তৃণমূল সরকারে আসার পরে ডোমকল শান্ত হয়।’’

ভেটাগুড়িতে এই গত অগস্টেও রেললাইনের ধার ঘেঁষে নিজের দলের দফতরে আক্রান্ত হন অঞ্চল তৃণমূল সভাপতি অনন্ত বর্মণ। সন্ধ্যেবেলা জনাকয়েক কর্মীর সঙ্গে বসেছিলেন তিনি। আচমকা বোমার আওয়াজ। তার পরেই তিরে জখম হন অনন্ত। বিজেপি কর্মীর উপরেও হামলা হয়েছে এখানে। বাড়ি ভাঙচুর, বোমাবাজি যেন নিত্য দিনের ঘটনা ছিল। ভেটাগুড়ি বাজার এলাকা সিসি ক্যামেরা দিয়ে মুড়ে দেয় পুলিশ। তার পরেও গন্ডগোল কমেনি।

ভেটাগুড়িতেই বাড়ি কেন্দ্রীয় প্ৰতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় তিনি যুব তৃণমূলের নেতা। সে সময় তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত হত ভেটাগুড়ি। পরে নিশীথ তৃণমূল থেকে বহিষ্কৃত হন। এখন ভেটাগুড়িতে দ্বন্দ্ব যেন তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে সমানে সমানে। দিন কয়েক আগেই নিশীথের বাড়ি ঘেরাওয়ের ডাক দেয় তৃণমূল। এক দিন পরেই ভেটাগুড়িতে পাল্টা মিছিল করে বিজেপি। হামলার অভিযোগ ওঠে। কয়েক জন ব্যবসায়ী জানান, বাজারে আসতেও মানুষ ভয় পাচ্ছিলেন। রাজ্যের উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ বলেন, ‘‘ভেটাগুড়ি-সহ গোটা দিনহাটাকে অশান্ত করার পিছনে কার হাত রয়েছে, তা সবাই জানেন।’’ বিজেপির কোচবিহার জেলার সাধারণ সম্পাদক বিরাজ বসুর পাল্টা দাবি, ‘‘দিনহাটা জুড়ে সন্ত্রাস করেছেন উদয়নই।’’

সন্ত্রাস বাড়ছে নানা দলের গোষ্ঠীকোন্দলেও। পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট ও রায়নায় বাম আমল থেকেই রাজনৈতিক অশান্তির ‘ধারাবাহিক’ ছবি পাওয়া যায়। দু’টি জায়গাতেই তৃণমূলের অন্দরে কোন্দল রয়েছে। বালির কারবার ঘিরেও নানা সময়ে দুই এলাকা তপ্ত। সম্প্রতি মঙ্গলকোটে তৃণমূলের দু’জন অঞ্চল সভাপতি গুলিতে খুন হন। দু’টি ক্ষেত্রেই দলের একাংশের নাম জড়িয়েছে। বোমাবাজির ঘটনাও ঘটেছে। দিন কয়েক আগে রায়নার সুকুর গ্রামে গুলিবিদ্ধ হন তৃণমূল নেতা ও তাঁর বাবা। তৃণমূলঅস্বীকার করলেও সেখানেও ওঠে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভিযোগ।

বদলায়নি কেশপুরও। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে এখানে অশান্তি চলছে। সিপিএম বনাম তৃণমূল থেকে ছবিটা বদলে এখন হয়ে গিয়েছে তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল। হিংসার ছবি বদলায়নি নন্দীগ্রাম, খেজুরিতেও। নন্দীগ্রামে টক্কর বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে। সম্প্রতি দু’দলের এক জন করে কর্মী খুন হন। দু’টি ঘটনাতেই উভয় দলের অনেকে জেলে। তার পরেও নন্দীগ্রামের ভেকুটিয়া, গোকুলনগর, আমদাবাদ, কালীচরণপুর বারবার অশান্ত হয়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতেও খেজুরিতে বোমা বিস্ফোরণে দুই তৃণমূল কর্মীর মৃত্যু হয়। পঞ্চায়েত ভোটের আগে নতুন করে উত্তপ্ত হচ্ছে এলাকা।

প্রশ্ন উঠেছে, সন্ত্রাসের এই আবহ কি এ বারের পঞ্চায়েত ভোটেও বজায় থাকবে?

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Panchayat Polls 2023 Violence West Bengal

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy