Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

গুনিনের গুঁতোয় ক্ষুদ্রান্ত্র ফুটো

জ্বর হয়েছিল। সঙ্গে ছিল মাথা ধরা আর ক্লান্তি। দিনমজুরির কাজে কয়েক দিন যেতে পারেননি যুবকটি। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার বদলে বাড়ির লোক নিয়ে গিয়েছিলেন এক গুনিনের কাছে। তিনি নিদান হাঁকলেন, ‘ছোকরাকে ভূতে ধরেছে। এখনই সেই ভূত তাড়াতে হবে।’

ক্ষুদ্রান্ত্রে ক্ষত। —নিজস্ব চিত্র

ক্ষুদ্রান্ত্রে ক্ষত। —নিজস্ব চিত্র

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:১৭
Share: Save:

জ্বর হয়েছিল। সঙ্গে ছিল মাথা ধরা আর ক্লান্তি। দিনমজুরির কাজে কয়েক দিন যেতে পারেননি যুবকটি। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার বদলে বাড়ির লোক নিয়ে গিয়েছিলেন এক গুনিনের কাছে। তিনি নিদান হাঁকলেন, ‘ছোকরাকে ভূতে ধরেছে। এখনই সেই ভূত তাড়াতে হবে।’

অভিযোগ, ভূত ছাড়ানোর নামে বেধড়ক পিটিয়ে ওই যুবকের ক্ষুদ্রান্ত্র ফুটো করে দেন তিনি। গত ১৮ জানুয়ারি এম আর বাঙুর হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে ক্ষুদ্রান্ত্রের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ বাদ দিয়ে যুবকটিকে বাঁচানো গিয়েছে। গুনিনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে যুবকের পরিবার। অভিযুক্ত গুনিন ফেরার।

পুরুলিয়া বা বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামের ঘটনা নয়। ঘটনাটি ঘটেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বেলেগাছি-ঘোলা এলাকায়। বারুইপুর স্টেশন থেকে দূরত্ব ১৫-১৬ কিলোমিটার। কলকাতা থেকেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায়।

শাহজাহান গায়েন নামে ওই অসুস্থ যুবককে গুনিনের কাছে নিয়েই বা যাওয়া হল কেন?

এলাকার বাসিন্দারা জানান, নাগালের মধ্যে ভাল হাসপাতাল বা চিকিৎসক না-পাওয়াটাই ওঝা-গুনিনের কাছে যাওয়ার প্রধান কারণ।

বেলেগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সৈফুদ্দিন মোল্লার আক্ষেপ, কাছাকাছি হাসপাতাল বলতে ক্যানিং হাসপাতাল প্রায় ১২ কিলোমিটার। বারুইপুর হাসপাতালের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটারেরও বেশি। এলাকায় তিনটি হেল্থ সাবসেন্টার বা উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। কিন্তু সেখানে মাসে এক দিন ডাক্তার আসেন। বাকি সময় থাকেন শুধু ‘অগ্‌জিলিয়ারি নার্স মিডওয়াইফ’ বা এএনএম-রা। ‘‘মানুষের আর দোষ কী? হঠাৎ কারও শরীর খারাপ হলে তো সব সময় সকলের পক্ষে অত দূরে রোগীকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। নিরুপায় হয়েই তাঁরা স্থানীয় হাতুড়ে, ওঝা-গুনিন, ঝাড়ফুঁক-তুকতাকের শরণাপন্ন হন,’’ বললেন সৈফুদ্দিন।

কী করলেন গুনিন?

শাহজাহান বলেন, ‘‘গুনিনের এক চেলা আমার কাঁধ দু’‌টো চেপে ধরেন। তার পরে গুনিন আমার পেটে এমন কষে গামছা বাঁধলেন যে, নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে পেট ফেটে যাওয়ার উপক্রম। কোঁকাতে লাগলাম। তা সত্ত্বেও গুনিন আমাকে মাটিতে ফেলে ওই অবস্থায় আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পেটে শুধু লাথি মেরে গেল, এক সময় আমি নেতিয়ে পড়লাম।’’

শাহজাহানের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ছে দেখে বাড়ির লোকজন তাঁকে এম আর বাঙুর হাসপাতালে নিয়ে যান। তাঁর ভাই গোলাম রসুল বললেন, ‘‘এখন বুঝেছি, বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। সব বুজরুকি। বারুইপুর থানায় অভিযোগ করেছি। জানিয়েছি পঞ্চায়েতকেও। আমাদের মতো এমন বোকামি যেন আর কেউ না-করেন।’’

বাঙুরে যে-সার্জন শাহজাহানের অস্ত্রোপচার করেন, সেই জয়দীপ রায়ের কথায়, ‘‘এ ভাবে মেরে যে ক্ষুদ্রান্ত্র ফুটো করে দেওয়া যায়, সেটা ভাবতে পারছি না।’’ তিনি জানান, রোগীর বাড়ির লোকজন প্রথমে পুলিশের কাছে যাননি। অপারেশন টেবিলে ছেলেটি গুনিনের পুরো বৃত্তান্ত জানানোর পরে ডাক্তারেরা ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারকে লিখিত ভাবে কেসটি ‘পুলিশ কেস’ হিসেবে নথিভুক্ত করতে বলেন। রোগীর আত্মীয়স্বজন তার পরে পুলিশের কাছে যান।

ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় শাহজাহান রক্ষা পেলেন ঠিকই। কিন্তু যে-সব এলাকার ধারেকাছে হাসপাতাল নেই, সেখানে বাসিন্দাদের উপায় নেই। ‘‘হাসপাতাল যত দূরে থাকবে, চিকিৎসক যত অমিল হবে, বেসরকারি জায়গায় চিকিৎসা যত দামি হবে, মানুষ ততই ওঝা-গুনিনের দিকে ঝুঁকবেন,’’ বলছেন চিকিৎসক ও মনোবিদেরা।

মনোবিদ প্রশান্ত রায়ের মতে, এ-সব ক্ষেত্রে সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট নিঃসন্দেহে বড় ভূমিকা নেয়। আবার ব্যথা, এলার্জি, হাঁপানি, হাত-পা কাঁপা, পেটের অসুখের মতো কিছু রোগের পিছনে অনেক সময় মনের ভূমিকা থাকে। গুনিন বা ওঝার উপরে ভরসা রেখে সেই রোগ সেরে গেলে গল্প ছড়ায় ঝড়ের গতিতে। আরও ১০ জন ওই গুনিনের কাছে দৌড়ন। এ ভাবেই এই অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা টিকে থাকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

state news intestine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE