Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
তোলাবাজির মরূদ্যান হাওড়া

অভিযোগ পেয়েও পুলিশ নিধিরাম

হাওড়ার হোটেল মালিকের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের একাধিক নেতার নাম জড়ানোর পাশাপাশি হাওড়া পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে অসংখ্য। প্রশ্ন উঠেছে, ওই হোটেলের ম্যানেজার আশিস মান্না গত শুক্রবার গোলাবাড়ি থানায় লিখিত অভিযোগ জানানোর পরেও পুলিশ কেন ব্যবস্থা নেয়নি? কেনই বা মারধরের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ নিতে আগ্রহ দেখায়নি তারা? পুলিশের অবশ্য দাবি, তাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই। কিন্তু পুলিশের এই দাবি যে নেহাতই কথার কথা, হোটেল ম্যানেজারের বক্তব্য থেকেই তা পরিষ্কার।

ভাই তথাগতকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মৃত ব্যবসায়ী সুমিত নাহার মেয়ে উপাসনা। মঙ্গলবার শৌভিক দে-র তোলা ছবি।

ভাই তথাগতকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মৃত ব্যবসায়ী সুমিত নাহার মেয়ে উপাসনা। মঙ্গলবার শৌভিক দে-র তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৪ ০৩:৩৪
Share: Save:

হাওড়ার হোটেল মালিকের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের একাধিক নেতার নাম জড়ানোর পাশাপাশি হাওড়া পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে অসংখ্য।

প্রশ্ন উঠেছে, ওই হোটেলের ম্যানেজার আশিস মান্না গত শুক্রবার গোলাবাড়ি থানায় লিখিত অভিযোগ জানানোর পরেও পুলিশ কেন ব্যবস্থা নেয়নি? কেনই বা মারধরের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ নিতে আগ্রহ দেখায়নি তারা? পুলিশের অবশ্য দাবি, তাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই। কিন্তু পুলিশের এই দাবি যে নেহাতই কথার কথা, হোটেল ম্যানেজারের বক্তব্য থেকেই তা পরিষ্কার। মঙ্গলবার আশিসবাবু বলেন, “পুলিশ বলেছিল, তাঁকে মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত দীপক সাউ হোটেলে গেলেই যেন থানায় খবর দেওয়া হয়।” প্রশ্ন উঠেছে, যার বিরুদ্ধে লিখিত ভাবে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হল, তাকে ধরতে পুলিশ নিজে কেন উদ্যোগী হল না? হাওড়া সিটি পুলিশের কমিশনার অজেয় রানাডে অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘লিখিত অভিযোগে শুধু মারধর ও বচসার কথা লেখা হয়েছিল। তাই পুলিশ বিষয়টাকে ততটা গুরুত্ব দেয়নি।”

গত চার দিনে পুলিশ তবে কী করেছে? হাওড়া জেলা পুলিশের এক শীর্ষকর্তা এ দিন জানান, দীপককে খুঁজে বের করতে জেলার গোয়েন্দা পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দীপক অবশ্য এখনও পুলিশের কাছে ফেরার! দীপকের স্ত্রী গীতাদেবী জানিয়েছেন, সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় মেয়েকে স্কুল থেকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ‘কাজ আছে’ বলে তিনি বেরিয়ে গিয়েছেন। এখনও বেপাত্তা। বার বার ফোন করলেও তাঁর মোবাইল বন্ধ। দীপক যে তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী, তা-ও জানিয়েছেন গীতাদেবী।

রবিবার গভীর রাতে বাগুইআটির বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন সুমিত নাহা। ওই ঘটনায় সোমবার রাতে বাগুইআটি থানায় অভিযোগ করেন মৃতের মা মঞ্জু নাহা। তাতে দীপক ছাড়াও রিয়াজ আহমেদ এবং তাদের সঙ্গীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই অভিযোগটিকেই এফআইআর হিসেবে গণ্য করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ৩৮৪ (তোলা আদায়), ৫০৬ (হুমকি), ৩৪ (কমন ইন্টেনশন) ধারায় মামলা হয়েছে। প্রথমে এই মামলায় ৩০৬ ধারা (আত্মহত্যায় প্ররোচনা) যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু যে হেতু ঘটনাটি আত্মহত্যা নয়, তাই ধারাটি বদলে ৩৮৪ দেওয়া হয়েছে। বিধাননগর কমিশনারেটের এক কর্তা জানান, প্রয়োজনে আরও ধারা যুক্ত করা হতে পারে। হাওড়া সিটি পুলিশের দাবি, বাগুইআটি থানার সঙ্গে যৌথ ভাবে তদম্ত করছে তারা।

ঘটনাটি যে এলাকার, সেই হাওড়া জেলা পুলিশ যে আগাগোড়া গা-ছাড়া মনোভাব দেখিয়েছে, বারেবারে সেই অভিযোগ তুলেছেন মঞ্জু নাহা এবং আশিস মান্না। মঞ্জুদেবীর প্রশ্ন, “গত ২০ জুন, শুক্রবার হোটেলের ম্যানেজারকে মারধর করার পর লিখিত অভিযোগ করা হয়েছিল। অভিযুক্ত তৃণমূল কর্মী দীপক ওই এলাকায় থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করল না কেন?” তাঁর অভিযোগ, “ম্যানেজারকে মারধরের ঘটনার পরেই যদি পুলিশ দোষীদের গ্রেফতার করত, তা হলে আমার ছেলের এমন পরিণতি হতো না। তৃণমূলের দুষ্কৃতীরাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। পুলিশ সব জেনেও তাদের গ্রেফতার করছে না।” মঞ্জুদেবীর প্রশ্ন, “আমরা কি জঙ্গলে বাস করছি?” আর আশিসবাবুর কথায়, “আমি অভিযোগ দায়ের করার পর পুলিশ মাত্র একবার তদন্তে এসেছিল। হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজটা নিয়ে যেতে তারা কোনও আগ্রহ দেখায়নি। আশঙ্কা হচ্ছে, তদন্ত ঠিক ভাবে হবে তো? নাকি শুধু প্রাণটাই যাবে?”

এই পরিস্থিতিতে নিজেদের সক্রিয়তা বোঝাতে এ দিন মরিয়া ছিল হাওড়ার গোলাবাড়ি থানা থেকে সিটি পুলিশ কমিশনার সকলেই। পুলিশ কমিশনার অজেয় রানাডের যেমন দাবি, “পুলিশ অভিযোগ পাওয়ার পরই অভিযোগকারীকে সঙ্গে নিয়ে তদন্তে গিয়েছিল। সিসিটিভি-র ফুটেজও খুঁটিয়ে দেখা হয়। পরের দিন সকালেও তদন্তকারী দল ফের হোটেলে গিয়েছিল। আমাদের তরফে চেষ্টার ত্রুটি নেই।” প্রায় একই সুর গোলাবাড়ি থানার।

রবিবার মধ্যরাতে সুমিতবাবুর মৃত্যু হলেও বিশাখাপত্তনম থেকে তাঁর স্কুলপড়ুয়া ছেলে না আসায় দেহ সৎকার হয়নি। এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ ছেলে তথাগত বাড়িতে এসে পৌঁছয়। আত্মীয়রা জানান, তথাগতকে বাবার মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি। বাড়ি ঢোকার পরে ঘরের দরজা বন্ধ করে মা আর ঠাকুমা তাকে পুরো বিষয়টা জানান। এর ঘণ্টা দেড়েক পর দুপুর দেড়টা নাগাদ কাঁচের গাড়িতে সুমিতবাবুর মৃতদেহ পৌঁছয় বাড়িতে। ছেলের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে মঞ্জুদেবী বলেন, “প্রশাসনের কাছে আমার প্রশ্ন, কেন এ ভাবে মরতে হল আমার ছেলেকে? আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।” এমনকী নিজেই এ বার থেকে হোটেলে বসার কথা জানিয়ে মঞ্জুদেবী বলেন, “এ বার থেকে আমিই হোটেলে বসব। আমার তো আর হারানোর কিছু নেই।”

শেষ দেখে ছাড়তে চান হোটেলের ম্যানেজার আশিস মান্নাও। এ দিনও সকাল ৯টা নাগাদ হোটেলে এসে প্রতিদিনের মতো কাজকর্ম তদারকি করেন তিনি। পরে আশিসবাবু বলেন, “গত কাল যতটা আতঙ্কিত ছিলাম, আজ ততটা নেই। আমি স্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছি, হাওড়া স্টেশনের মাফিয়া চক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছি। পিছিয়ে আসার জায়গা নেই। যে কোনও দিন হয়তো খুন হয়ে যেতে পারি। বাড়িতে সাদা কাপড় রেডি রেখো।”

এ দিন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এবং বিজেপি নেতা রাহুল সিংহ যান সুমিতবাবুদের বাড়িতে। তাঁর পরিবারকে সমবেদনা ও পাশে থাকার আশ্বাস দেন। তার মধ্যেই স্থানীয় রাজারহাট-নিউটাউনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর দেবেশ সাহার একটি মন্তব্য ঘিরে তুমুল বিতর্ক বেধেছে। দেবেশবাবু বলেন, “আমার মনে হয় না হুমকির কারণে আতঙ্কে ওঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। হাওড়ার হোটেলগুলি ঘিরে বহু বছর ধরেই দুষ্কৃতীরাজ চলছে। গত ৪০ বছর ধরে সুমিতবাবুদের ব্যবসা। এই ধরনের সমস্যা ওঁর গা সওয়া হয়ে যাওয়ার কথা।” এখানেই না থেমে সুমিতবাবুর মৃত্যুর জন্য তৃণমূলের কেউ দায়ী নয় বোঝাতে গিয়ে তাঁর পারিবারিক বিষয় নিয়েও মন্তব্য করে বসেন দেবেশবাবু। ওই তৃণমূল কাউন্সিলরের কথায়, “ওঁর পরিবারে একটা সমস্যা ছিল। সেটাও ওঁর মানসিক যন্ত্রণার কারণ ছিল। সেই যন্ত্রণা থেকেও ওঁর মৃত্যু হতে পারে।” তৃণমূল কাউন্সিলরের ওই মন্তব্যে সুমিতবাবুর পরিবারের লোকেরা এবং প্রতিবেশীরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তাঁদের বক্তব্য, এই ধরনের কথা বলে দেবেশ সাহা অত্যন্ত কুরুচিকর কাজ করেছেন। প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতেই এই সব মন্তব্য বলেও অভিযোগ তোলেন তাঁরা। একই কথা বলেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। এ দিন সুমিতবাবুর বাড়িতে বসে তৃণমূল কাউন্সিলরের ওই মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যে দলের মুখ্যমন্ত্রী দোষীদের ঢাকতে আকছার এই ধরনের কথা বলে থাকেন, সেখানে কাউন্সিলর তো বলবেনই!”

এ দিন সূর্যকান্তবাবু প্রায় ৪৫ মিনিট সুমিতবাবুর স্ত্রী ও মা’র সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি বলেন, “কামদুনিতে তো দেখেছি, কী ভাবে সবাইকে কিনে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এখানে শেষ দেখে ছাড়ব।”

বিকেলে সুমিতবাবুর বাড়িতে আসেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। তাঁর কাছে মঞ্জুদেবী অভিযোগ করেন, “আমাদের হোটেলের পাশে রিয়াজের বাবার একটা ছোট হোটেল আছে। এক বছর ধরে ওরা আমাদের হোটেলটার দখল নিতে চাইছিল। ক’দিন আগে দীপক আমাকেও ফোন করে ছেলেকে পাঠাতে বারণ করেছিল। বলেছিল, পাঠালে গুলি করে মারবে।”

পরে রাহুলবাবু বলেন, “হাওড়ায় যারা তোলাবাজিতে যুক্ত, তারা যে তৃণমূলের কর্মী, স্থানীয় বিধায়ক সেটা স্বীকার করেছেন।” একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “তৃণমূল দলটা পুরোটাই মস্তানদের দখলে চলে গিয়েছে। যেখানে অভিযুক্তের পক্ষ নিয়ে আদালতে মন্ত্রী সওয়াল করেন, সেখানে প্রশাসনের কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি?” রাহুলবাবু জানান, আজ, বুধবার দুপুর ৩টেয় গোলাবাড়ি থানার সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বিজেপি। বিকেল ৫টায় সুমিতবাবুর বাড়ির সামনে পথসভাও হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anti social howrah hotel sumit naha bridge lodge
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE