গঙ্গাকুমারীকে বিহারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে প্রথমে রাজি ছিলেন রাজ্যের সমাজকল্যাণ সচিব রোশনী সেন। তিনি সেইমতো চিঠিপত্র তৈরিও করে ফেলেছিলেন। সমাজকল্যাণ দফতর সূত্রের খবর, দফতরের কর্তাদের একাংশ তাতে আপত্তি তোলেন। কারণ তাঁরা বুঝেছিলেন ওই কিশোরী বিহারে ফিরে হোমের অবস্থার কথা জানালে, অন্য রাজ্যের সামনে পশ্চিমবঙ্গের মাথা হেঁট হবে। তাঁদের আপত্তিতে রোশনী সেন পিছিয়ে আসেন। গঙ্গা যে হোমে ছিল বাঁকুড়ার সেই নবদিগন্ত কটেজ হোম নিয়ে একাধিক অভিযোগ উঠছিল বহু দিনই। গঙ্গার ফেরত যাওয়া আটকানোর পর সমাজকল্যাণ দফতর ওই হোমে তদন্তের নির্দেশ দেয়। তাতেই কেঁচো খুড়তে সাপ বেরোয়।
বাঁকুড়া শিশুকল্যাণ কমিটির চেয়ারম্যান শেখ মুরশালিন জানিয়েছেন, ওই হোমে আশ্রয় পাওয়া অনেক নাবালিকাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে দেহব্যবসার কাজ করানো হত বলে তদন্তে জানা গিয়েছে। এর পরেই গত ২৫ এপ্রিল হোমটি বন্ধ করার সরকারি নির্দেশ দেন রাজ্যের সমাজকল্যাণ সচিব। হোমের প্রধান শচীদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করা হয়। গঙ্গাকুমারী-সহ অন্য আবাসিকাদের বিভিন্ন হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
জানুয়ারি মাসে হাওড়ার লিলুয়া হোম থেকে নবদিগন্ত হোমে পাঠানো হয়েছিল গঙ্গাকুমারীকে। একই দিনে অন্য দু’টি হোম থেকে আরও ২৬ জন নাবালিকাকে নবদিগন্তে পাঠানো হয়। এর কিছু দিন পরেই বিহারে ফোন করে গঙ্গা জানিয়েছিল, ফিরে যেতে চায় সে। ৪ এপ্রিল বাঁকুড়া শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে হরিয়ালগাড়ায় প্রায় জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত নবদিগন্তে যান বাঁকুড়া শিশুকল্যাণ কমিটি ও বাঁকুড়ার জেলাশাসকের অফিসের প্রতিনিধিরা। সেখানকার অবস্থা দেখে ও শুনে তাঁদের চোখ কপালে!
ঠিক কী রকম সেই অভিজ্ঞতা? তদন্তকারীরা রিপোর্ট দিয়ে জানিয়েছেন, হোমের লাইসেন্স থাকলেও বাঁকুড়া শিশুকল্যাণ কমিটির খাতায় নথিভুক্ত নয় নবদিগন্ত! এক হোম থেকে অন্য হোমে আবাসিকদের বদলি করলে সংশ্লিষ্ট শিশুকল্যাণ কমিটির অনুমতি নেওয়া দরকার। গঙ্গা-সহ ২৭টি মেয়েকে নবদিগন্তে পাঠানো হলেও অনুমতি নেওয়া হয়নি। বাঁকুড়া শিশুকল্যাণ কমিটির চেয়ারম্যান শেখ মুরশালিনের কথায়, “জঙ্গলে মেয়েদের হোম অথচ তাতে কোনও নিরাপত্তাকর্মী নেই! ১৪-১৫ বছরের মেয়েরা শতছিদ্র জামায় কোনও রকমে লজ্জা নিবারণ করছিল। তারাই যৌন হেনস্থার কথা জানিয়েছে।”
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় খাবার, ওষুধ কিছুই দেওয়া হত না মেয়েদের। দু’জন নাবালিকা যক্ষ্মায় ভুগে ভুগে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। তা ছাড়া নবদিগন্তে পাঠানো ২৭ জন মেয়ের যে তালিকা ছিল, তার মধ্যে ৭ জনকে তাঁরা দেখতেই পাননি। পরের দিন তিন জনকে হাজির করে হোম কর্তৃপক্ষ বলেন, কলকাতায় চিকিৎসার জন্য তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
মুরশালিন বলেন, “জেরায় জানা গিয়েছে, ওই নাবালিকাদের যৌন পেশায় নামানোর জন্যই কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হত।” নিখোঁজ বাকি চার জনের ব্যাপারে হোম কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা পালিয়ে গিয়েছে। যদিও তা নিয়ে থানায় কোনও অভিযাগ দায়ের করেননি হোম-কর্তৃপক্ষ। পরে একটি মেয়েকে উদ্ধার করা হয়। বাকি ৩ জন এখনও নিখোঁজ।
মহিলা ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজাও জানিয়েছেন, নবদিগন্তে গোলমালের খবর আগে থেকেই ছিল। এত দিনে তা সত্যি প্রমাণিত হল। তাঁর কথায়, “বহু বছরের অবহেলায় পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছে। জেলায়-জেলায় নজরদারি কমিটিগুলিও কাজ করছে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি।”
সব কিছুর পরেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। হোম পরিচালনায় নিজেদের গাফিলতি ভিন্ রাজ্যের কাছ থেকে আড়াল করতেই কি গঙ্গাকুমারীকে পটনায় ফেরত পাঠাতে আপত্তি পশ্চিমবঙ্গের, নাকি গঙ্গার নিরাপত্তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের চিন্তার সত্যিই কোনও কারণ রয়েছে? বিহারের কেউ বা কারা কি কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে গঙ্গাকুমারীকে ফেরত পেতে চাইছে? প্রকৃত তদন্ত ছাড়া এর উত্তর মেলা দুষ্কর। এ সব প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট উত্তর আপাতত নেই সরকারের কাছে।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy