Advertisement
E-Paper

কাজিয়া-ক্লান্ত মতুয়া মহলে অনুপ্রবেশের চেষ্টায় দেবেশ

‘আগ মার্কা’ মতুয়া কে, এই নিয়েই কাজিয়া ঠাকুরবাড়িতে! এত দিন ঠাকুরবাড়ি বলতে জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের ভিটেবাড়ি বোঝাত। রাজ্য রাজনীতির জটিল ঘূর্ণাবর্তে ইদানীং গাইঘাটার ঠাকুরনগরে মতুয়াদের পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ির নামও বিখ্যাত! এই বাড়িরই বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর ছিলেন বনগাঁর তৃণমূল সাংসদ। তাঁর মৃত্যুতেই বনগাঁয় অকাল-ভোট। প্রয়াত কপিলবাবুর স্ত্রী মমতাবালা ঠাকুরকে এ বার প্রার্থী করেছে তৃণমূল।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৮
শিবির বদলেছেন। প্রচারে চলেছেন বিজেপির হয়ে। তবুও তৃণমূল সমর্থকদের প্রবল উচ্ছ্বাস লকেটকে ঘিরে। কৃষ্ণগঞ্জের শান্তিপাড়ায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

শিবির বদলেছেন। প্রচারে চলেছেন বিজেপির হয়ে। তবুও তৃণমূল সমর্থকদের প্রবল উচ্ছ্বাস লকেটকে ঘিরে। কৃষ্ণগঞ্জের শান্তিপাড়ায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

‘আগ মার্কা’ মতুয়া কে, এই নিয়েই কাজিয়া ঠাকুরবাড়িতে!

এত দিন ঠাকুরবাড়ি বলতে জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের ভিটেবাড়ি বোঝাত। রাজ্য রাজনীতির জটিল ঘূর্ণাবর্তে ইদানীং গাইঘাটার ঠাকুরনগরে মতুয়াদের পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ির নামও বিখ্যাত! এই বাড়িরই বড় ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর ছিলেন বনগাঁর তৃণমূল সাংসদ। তাঁর মৃত্যুতেই বনগাঁয় অকাল-ভোট। প্রয়াত কপিলবাবুর স্ত্রী মমতাবালা ঠাকুরকে এ বার প্রার্থী করেছে তৃণমূল। অন্য দিকে, কপিলের ভ্রাতুষ্পুত্র সুব্রত ঠাকুর লড়ছেন বিজেপি-র টিকিটে। ঠাকুরবাড়ির দু’পক্ষের দীর্ঘ দিনের পারিবারিক দ্বৈরথ এ বার সরাসরি ভোটের ময়দানে উপচে এসে গোটা আবহেই অন্য মাত্রা জুড়েছে!

কপিলের ভাই মঞ্জুলকৃষ্ণের বক্তব্য, মমতাবালা ঠাকুর পরিবারের বাইরের লোক। শরীরে খাঁটি মতুয়া-রক্ত বইছে কোথায়? মঞ্জুল এবং তাঁর পুত্র সুব্রতকে তৃণমূল থেকে দলে টানার পরে বিজেপি-র নেতাদের গলাতেও এখন মঞ্জুলের সুর। পাল্টা কোমর বেঁধে তৃণমূল আবার বলছে, বড়মার আশীর্বাদ আছে মমতাবালার সঙ্গে। তাই তিনিই মতুয়া সমর্থনের প্রকৃত দাবিদার।

বড়মা বীণাপাণিদেবীর বয়স প্রায় ৯৬। অশক্ত শরীরেও মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান উপদেষ্টা বড়মা এখনও মতুয়াদের বড় বল-ভরসা। বড়মার এক দিকে এখন পুত্রবধূ মমতাবালা, অন্য দিকে তাঁর বড় নাতি সুব্রত। বড় ছেলে কপিলের মৃত্যুর পরে অবশ্য মতুয়া মহাসঙ্ঘের ভাঙন ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি বড়মা। মঞ্জুল নতুন সঙ্ঘাধিপতি হয়েছেন। আবার পাল্টা কমিটি গড়ে সঙ্ঘাধিপতি হয়েছেন মমতাও! পারিবারিক মনোমালিন্য, কাদা ছোড়াছুড়ি, থানা-পুলিশ কিছুই বাকি নেই!

ঠাকুরবাড়িতে উন্নয়নের বন্যার কথা বলে যে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ককে ২০০৮ সাল থেকে আঁচলের তলায় পরম যত্নে ধরে রাখতে পেরেছিলেন তৃণমূল নেত্রী, সে দিন এখন গিয়েছে! কারণ, এ বার মতুয়া শিবিরেই ফাটল। একে তো ঠাকুরবাড়ির লোককে ভাঙিয়ে নিয়ে গিয়েছে বিজেপি। তার উপরে মতুয়াদের নাগরিকত্বের দাবির সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে বিজেপি-র একটা সহজ সম্পর্ক আছে। ঠাকুরবাড়িতে ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গেই মতুয়া ভোটের বড় অংশ বিজেপি-র দিকেই ঝুঁকে পড়ার কথা। কিন্তু এত কিছুর পরেও বিশেষ উদ্বেগ চোখে পড়ছে না ঘাসফুল শিবিরে!

কেন? তার কারণ, বিজেপি-র প্রার্থী নির্বাচনই! বনগাঁর ভোটে এ বার তৃণমূলের প্রধান কাণ্ডারী, দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কথায়, “সুব্রত ও তাঁর বাবা মঞ্জুলকৃষ্ণের জনসংযোগ বলে কোনও বস্তু নেই। ওঁদের কোনও প্রভাবও নেই! তার উপরে সুব্রতের বিরুদ্ধে গরুপাচারের অভিযোগও আছে।” বিজেপি-র একটা বড় অংশও সুব্রতকে প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। সব মিলিয়ে সুব্রতকে বিরোধী প্রার্থী হিেসেবে পেয়ে তৃণমূলের লোকজন ঠাকুরবাড়িতে মিষ্টি বিলি করেছেন! মমতাবালার দাবি, “মতুয়াদের মধ্যে সুব্রতের কোনও গ্রহণযোগ্যতাই নেই। তাই মতুয়া ভোট ভাগ হবে না!”

তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হচ্ছে, এই দাবি করে সুব্রতের বক্তব্য, “মতুয়ারা এখন সমাজে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। শিক্ষিত হয়েছেন। তাঁরাই ভালমন্দ বিচার করবেন।” সুব্রতেরও দাবি, মতুয়া ভোট এককাট্টা হয়ে আসবে তাঁর পক্ষেই।


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

ঠিক এই জায়গাতেই লড়াইয়ের ময়দানে ঢুকে পড়ছেন সিপিএম প্রার্থী দেবেশ দাস। মঞ্জুল ও তাঁর পুত্র যত দিন তৃণমূলে ছিলেন, তত দিন কি তাঁদের সাত খুন মাফ ছিল জ্যোতিপ্রিয়দের অভিযোগ শুনে প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আবার এমন বিতর্কিত চরিত্রদেরই দলে টেনে বিজেপি কি পরিবর্তন আনবে, এলাকায় ঘুরছে সেই প্রশ্নটাও। আর এরই ফায়দা নিতে চাইছেন পেশায় অধ্যাপক, ভদ্রলোক বলে পরিচিত প্রাক্তন মন্ত্রী দেবেশবাবু।

আট মাস আগের লোকসভা ভোটে বনগাঁয় চার বড় দলের যাঁরা প্রার্থী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সিপিএমের দেবেশবাবুই একমাত্র অপরিবর্তিত। নানা কারণে বাকি সকলেরই মুখ বদলেছে। সেখানে দেবেশবাবু সেই কথাই আরও জোরালো ভাবে বলছেন, যা গত লোকসভা ভোটের সময় বলতেন। তাঁর দাবি, “মতুয়াদের নিয়ে যে রাজনীতি হচ্ছে, তা সাধারণ মতুয়া সমাজের মানুষ বুঝতে পারছেন। ফলে, এ বার মতুয়াদের সমর্থন পাব আমরা।” ইদানীং জেলার নানা প্রান্তে বামেদের সভায় লোকও জমছে। পুরনো বহু মুখও ফিরতে দেখা দেখা যাচ্ছে। সিপিএম তাই আশা করছে, ভোটব্যাঙ্কে রক্তক্ষরণের প্রবণতা এ বার অন্তত একটু থামবে।

দেবেশবাবুর কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে মতুয়া সম্প্রদায়ের কারও কারও মধ্যে। মতুয়া মহাসঙ্ঘের বনগাঁ মহকুমা কমিটির সম্পাদক মনোজ টিকাদারের বক্তব্য, “অতীতে দেখা গিয়েছে, নির্বাচনের আগে সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হত, কোন প্রার্থীকে সমর্থন করতে হবে। কিন্তু এ বার কমিটিই দু’টো! মতুয়া ভোট তো বিভক্ত হবেই!” মতুয়া ধর্ম প্রচারক রবি হালদারের কথায়, “আমরা এ বার নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুযায়ীই ভোট দেব।”

‘নিজেদের মতাদর্শ’ ভোট হলে মতুয়া সমর্থনের কিছু ভাগ তাদের দিকেও আসবে, আশাবাদী কংগ্রেসও। কিন্তু দুর্বল সংগঠনের কংগ্রেসকে চিন্তায় রেখেছে তাদের আনকোরা প্রার্থী বাছাই! শুধু রাজনীতিতে নয়, এলাকাতেও খুব একটা পরিচিতি নেই বছর উনত্রিশের কংগ্রেস প্রার্থী কুন্তল মণ্ডলের। তাঁর নাম ঘোষণা হওয়ার পরে স্থানীয় কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের একাংশ দলের দফতরে ঢুকে প্রার্থীকে হেনস্থা করেছেন। কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর হাত মাথায় থাকায় কুন্তল লড়ে যাচ্ছেন। অধীরও বলছেন, “ঠাকুরবাড়ি এখন কাদা ছোড়াছুড়ির জায়গা হয়ে গিয়েছে!”

বস্তুত, ঠাকুরবাড়ির দুই প্রার্থীকে নিয়ে নিরন্তর ‘কাদা ছোড়াছুড়ি’ই যেন এ বারের উপনির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে! মঞ্জুলকে রাজ্যের উদ্বাস্তু, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছেলে সুব্রতকে লোকসভায় তৃণমূলের টিকিট দেওয়া হোক, এমনটাই নাকি চেয়েছিলেন মঞ্জুল। দাবি না মেটাই নাকি সপুত্র পদ্ম-শিবিরের আশ্রয় নেওয়ার কারণ! জ্যোতিপ্রিয়বাবু তাই এখন বলছেন, “মঞ্জুল দলের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন!”

সুব্রতদের ‘সম্পদ’ ভেবে রাহুল সিংহেরা দলে টেনে নিলেও বিজেপি-র অন্দরে কিন্তু অস্বস্তি কম নয়! প্রার্থী অপছন্দ হওয়ায় বিজেপি-র প্রবীণ নেতা কিশোর বিশ্বাস নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েই পড়েছেন। তাঁকে দল থেকে ঝটপট বহিষ্কার করে বিদ্রোহ সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আর আছ ভোটের জলহাওয়াই এ বারের অকাল-নির্বাচনের নতুন মাত্রা!

bongaon by-election
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy