Advertisement
১৭ মে ২০২৪

ক্রমশ ডুবছি, আক্ষেপ নেতাই-ফেরারদের

ইন্দ্রবালা মণ্ডলের শ্রাদ্ধবাসরে সে দিন ঘুরেফিরে আসছিল একটাই কথা। তিনি আরও ক’দিন বাঁচতেন। কিন্তু নেতাই গ্রামের ওই বৃদ্ধা নাকি ছোট মেয়েকে টানা তিন বছর চোখের দেখা না দেখতে পারার শোক ও আক্ষেপেই মারা গেলেন। ছোট মেয়ে বিয়ে-থা করেননি বলে সন্তানদের মধ্যে তাঁর উপরেই ইন্দ্রবালার টান ছিল সব চেয়ে বেশি। মাস খানেক আগে ইন্দ্রবালার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে নিমন্ত্রিতদের অনেকেই সে কথা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৪ ০৩:৫৯
Share: Save:

ইন্দ্রবালা মণ্ডলের শ্রাদ্ধবাসরে সে দিন ঘুরেফিরে আসছিল একটাই কথা। তিনি আরও ক’দিন বাঁচতেন। কিন্তু নেতাই গ্রামের ওই বৃদ্ধা নাকি ছোট মেয়েকে টানা তিন বছর চোখের দেখা না দেখতে পারার শোক ও আক্ষেপেই মারা গেলেন। ছোট মেয়ে বিয়ে-থা করেননি বলে সন্তানদের মধ্যে তাঁর উপরেই ইন্দ্রবালার টান ছিল সব চেয়ে বেশি। মাস খানেক আগে ইন্দ্রবালার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে নিমন্ত্রিতদের অনেকেই সে কথা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন।

ইন্দ্রবালা দেবীর ছোট মেয়ের নাম ফুল্লরা মণ্ডল। তিনি ২০১১-র ১৫ জানুয়ারি থেকে এখনও ফেরার। সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটির সদস্য ও পার্টির মহিলা সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদক ফুল্লরা নেতাই গণহত্যা মামলায় অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত। নেতাই গ্রামে ফুল্লরা মণ্ডলদের বাড়ির কাছেই রথীন দণ্ডপাটের বাড়ি। যেখানে তৈরি হওয়া সিপিএমের সশস্ত্র ক্যাডারদের শিবির থেকে চলা গুলিতে ২০১১-র ৭ জানুয়ারি ন’জন গ্রামবাসী নিহত হন বলে সিবিআই চার্জশিটে জানিয়েছে।

ফেরার ফুল্লরা স্বভাবতই মায়ের শেষকৃত্য ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে থাকতে পারেননি। আবার তেমনই এ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতে পারেননি নেতাই মামলার আর এক ফেরার অভিযুক্ত, সিপিএমের লালগড় লোকাল কমিটির সম্পাদক জয়দেব গিরি। একই রকম হতাশা ও আক্ষেপ পার্টির বেলাটিকরি লোকাল কমিটির সম্পাদক চণ্ডী করণেরও। তাঁর ছেলেও এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময়ে বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে যেতে পারেনি।

লালগড়ে সিপিএমের মোট আট জন নেতা-নেত্রী-কর্মী নেতাই মামলায় অভিযুক্ত হয়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর এই অবস্থাতেই গত ৩ মার্চ মেদিনীপুর জেলা আদালতে শুরু হয়ে গিয়েছে নেতাই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ। সিপিএম সূত্রের খবর, লালগড়ে পার্টির জোনাল কমিটির সম্পাদক অনুজ পাণ্ডে-সহ আট জনকেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, মামলার গতিপ্রকৃতি দেখে তবেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা দল চিন্তা করবে, আর তত দিন পর্যন্ত তাঁদের লুকিয়েই থাকতে হবে।

কিন্তু পার্টির ওই নির্দেশ তাঁদের সবাই মন থেকে মেনে নিতে পারছেন কোথায়? ভিন রাজ্য থেকে টেলিফোনে ফেরারদের এক জন আনন্দবাজারকে বললেন, “আর সহ্য হচ্ছে না। এখন মনে হচ্ছে, রাজনীতিতে এসে, বিশেষ করে সিপিএম করে বড় ভুল করেছি।” তাঁর বক্তব্য, পার্টি প্রথমে বলেছিল, মামলা থেকে বেকসুর খালাস হওয়া যাবে, পরে জানাল, ফেরার অবস্থাতেই জামিনে মুক্তি মিলবে। “আর এখন দেখছি, শুধু এত দিন পালিয়ে থাকার অপরাধেই আদালত শাস্তি দেবে,” আক্ষেপ ওই নেতার।

অন্য একটি রাজ্যে আত্মগোপন করে থাকা ফেরার আর এক নেতা ফোনে বললেন, “মাওবাদীদের প্রতিরোধ করার জন্য নেতাই গ্রামে সশস্ত্র শিবির তৈরি হওয়ার দিন জোনাল সদস্য হিসেবে আমাকে থাকতে বলা হয়েছিল। আর কোনও ভূমিকা আমার ছিল না।” সে জন্য তিনি গোড়াতেই পার্টির জেলা নেতৃত্বকে জানান, তিনি আত্মসমর্পণ করতে চান। কিন্তু পার্টি শোনেনি। ওই নেতার কথায়, “যত দিন গড়াচ্ছে, ততই চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছি।”

সিপিএমের ওই দুই ফেরার নেতারই বক্তব্য, নেতাইয়ে ভুল হয়েছিল বলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কিছু দিন আগে যে মন্তব্য করেছিলেন, সেটা তাঁরা কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। দু’জনেরই কথায়, “বুদ্ধবাবুর ওই মন্তব্য দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক।” সিপিএম সূত্রে জানা গিয়েছে, গোড়ায় ওই আট জনকে আত্মগোপন করতে হবে বলে জানিয়ে পার্টির জেলা নেতৃত্বের একাংশ আশ্বাস দিয়েছিল, দিন পনেরোর মধ্যেই সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কিন্তু সিবিআইয়ের হাতে মামলার তদন্তভার যাওয়ার পর পার্টির ওই নেতারা তাঁদের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেন। এক ফেরার নেতার কথায়, “ওই নেতারা বলেছিলেন, সরকার আমাদেরই হচ্ছে। ভোটের পর সব ঠিক হবে। আর বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বলা হল, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন প্রতিকূল, কিছু করা যাবে না।”

কিন্তু পার্টি নেতৃত্বের একাংশ ওই আট জনকে আত্মগোপন করতে বলেছিলেন কেন? সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, “মাওবাদীদের মোকাবিলায় আমাদের সশস্ত্র ক্যাডারদের শিবির তৈরি করার পিছনে জেলার কয়েক জন শীর্ষ নেতার বড় ভূমিকা ছিল।” তাঁর বক্তব্য, শুধু নেতাই নয়, লালগড় থানা এলাকা জুড়ে সেই সময়ে সিপিএমের সশস্ত্র ক্যাডারদের শিবির হয়েছিল লালগড়ে সশস্ত্র শিবির তৈরি হয়েছিল ন’টি এবং সেগুলি তৈরি করার ক্ষেত্রে ফেরার আট জনের একাংশ আসলে ওই শীর্ষনেতাদের নির্দেশ কার্যকর করেছিলেন মাত্র।

ওই জেলা নেতা বলেন, “ওই আট জন ধরা পড়ে গেলে শীর্ষনেতাদের ভূমিকার কথা বেরিয়ে পড়ার ঝুঁকি ছিল এবং সে জন্যই তাঁদের আত্মগোপন করতে বলা হয়।” দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, “তিন বছর ধরে যা পরিস্থিতি তৈরি হল, তাতে আমাদের ফেরার আট জনের সঙ্কট বাড়ল বই কমল না।” তাঁর মতে, ওই আট জন দোষী নাকি নির্দোষ পরের ব্যাপার, কিন্তু এত দিন ধরে পালিয়ে থাকার বিষয়টি সম্ভবত তাঁদের বিরুদ্ধেই যাবে।

পশ্চিম মেদিনীপুরে সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের বক্তব্য, “নেতাই মামলায় আমাদের দলের ওই আট জন ফেরার কী করবেন, সেই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনও আসেনি।”

এই অবস্থায় সিবিআই কী করছে?

সিবিআইয়ের আইনজীবী পার্থ তপস্বী বলেন, “নেতাই মামলায় অভিযুক্ত সিপিএমের ওই আট জন ফেরারের খোঁজে লাগাতার তল্লাশি চলছে। ফেরার হিসেবেই তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করা হয়েছিল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

netai surbek biswas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE