Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
সারদা-অস্ত্রে বিধ্বংসী মোদী

ক্ষমতায় এলে রেহাই পাবে না কোনও দোষীই

গোটা শ্রীরামপুর স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভর্তি তো বটেই। উল্টো দিকের ক্লাবের মাঠেও তিলধারণের জায়গা নেই! জি টি রোড থেকে সভাস্থল পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে কাতার দিয়ে লোক দাঁড়িয়ে! মাঠের জনতা বলতে মূলত ১৮ থেকে ২৮। যতক্ষণ বক্তৃতা চলল, ‘মোদী, মোদী’ চিৎকারে তারা ভরিয়ে তুলল রাতের আকাশ!

হাতে হাত। শ্রীরামপুরের বিজেপি প্রার্থী বাপ্পি লাহিড়ীর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। রবিবার।  ছবি: সুমন বল্লভ।

হাতে হাত। শ্রীরামপুরের বিজেপি প্রার্থী বাপ্পি লাহিড়ীর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী। রবিবার। ছবি: সুমন বল্লভ।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুকান্ত সরকার
শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:০৯
Share: Save:

গোটা শ্রীরামপুর স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভর্তি তো বটেই। উল্টো দিকের ক্লাবের মাঠেও তিলধারণের জায়গা নেই! জি টি রোড থেকে সভাস্থল পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে কাতার দিয়ে লোক দাঁড়িয়ে!

মাঠের জনতা বলতে মূলত ১৮ থেকে ২৮। যতক্ষণ বক্তৃতা চলল, ‘মোদী, মোদী’ চিৎকারে তারা ভরিয়ে তুলল রাতের আকাশ!

ভোট-মরসুমে তৃতীয় বারের জন্য এ রাজ্যে এসে এমন মঞ্চকে সদ্ব্যবহার করতে ছাড়লেন না নরেন্দ্র মোদী। রামকৃষ্ণ মিশনের সূত্রে বাংলা যে তাঁর কাছে তীর্থভূমি, বক্তৃতায় সে কথা উল্লেখ করেই তিনি আক্রমণ শানালেন সারদা প্রসঙ্গে। ‘মা সারদা’কে চিট ফান্ড বানিয়ে তুলেছে মমতার সরকার এই অভিযোগ করে হাততালিও কুড়োলেন বিপুল। তিন বারের মধ্যে প্রথম বার ব্রিগেড যদি দেখে থাকে ‘নরম’ মোদীকে এবং দ্বিতীয় বার শিলিগুড়ি যদি অপেক্ষাকৃত ‘গরম’ মোদীকে, তা হলে তৃতীয় বারে শ্রীরামপুর দেখল বিধ্বংসী মোদীকে!

রাজ্য রাজনীতি, বিশেষ করে ভোট রাজনীতির চাকা এখন ঘুরছে সারদা কাণ্ডকে কেন্দ্র করে। এই নিয়ে বাম-কংগ্রেস তো বটেই, রাজ্য বিজেপিও সরকারের সমালোচনায় সরব। শিলিগুড়ির সভায় মোদীর বক্তৃতায় সেই প্রসঙ্গ ওঠে। কিন্তু তাতে জোরালো ভাব ততটা ছিল না বলে বিজেপিরই কেউ কেউ জানিয়েছিলেন। রবিবার শ্রীরামপুরে মোদী যে ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করলেন, তা আজ পর্যন্ত বিজেপি কোনও শীর্ষ নেতা করেছেন কি না সন্দেহ। এবং সেই আক্রমণের মূল অস্ত্রই ছিল সারদা কেলেঙ্কারি। এই কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি মানুষের প্রতিটি পাই-পয়সার হিসেব পর্যন্ত দাবি করেছেন মোদী।

মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী বলেছেন, “মমতাজি, যে বাংলায় মা সারদার পুজো হতো, সেই মা সারদাকে চিট ফান্ড বানালেন কী ভাবে!” কটাক্ষ করেছেন, “আপনার আঁকা ছবি ১ কোটি ৮০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আপনার ছবি কে কিনল, তা বাংলার মানুষ জানতে চায়। আপনার মতো এমন চিত্রকরের জন্য দেশ গর্বিত!” দলীয় তহবিলের জন্য তৃণমূল নেত্রীর নিজের আঁকা ছবির প্রদর্শনী থেকে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন ছবি কিনেছিলেন, এমন অভিযোগ গত এক বছর ধরে বারেবারেই উঠেছে। অন্য বিরোধীদের মতোই সেই অভিযোগ এ দিন শোনা গিয়েছে মোদীর গলায়। পাশাপাশি মোদী হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “দিল্লিতে আমাদের সরকার হওয়ার পরে এই কেলেঙ্কারির ব্যাপারে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড়া হবে না!”

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমকেও রেয়াত করেননি মোদী। অভিযোগ করেছেন, “মমতা-চিদম্বরম মিলে সারদার অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন! তাতে লাভ হবে না!”

শ্রীরামপুরের বাপ্পি লাহিড়ী, হুগলির চন্দন মিত্র এবং হাওড়ার জর্জ বেকার এই তিন প্রার্থীর সমর্থনে এ দিন সমাবেশ করেন মোদী। ব্রিগেডে সকলের মন ভরেনি, এই আক্ষেপ জানিয়েই দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর কাছে এ রাজ্যে আরও কিছু সভা করার আর্জি জানিয়েছিলেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পরে এসে এবং ঘণ্টাখানেকের টানটান বক্তৃতার পরে মোদী এ দিন যখন শ্রীরামপুর ছেড়েছেন, রাহুলবাবুর মুখে স্বস্তির হাসি। রাজ্যে যে কয়েকটি আসনকে ‘সম্ভাবনাময়’ হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিজেপি নেতৃত্ব, শ্রীরামপুর তার অন্যতম। উত্তরপাড়া, রিষড়া, কোন্নগরের হিন্দিভাষী বলয়ে মোদীর প্রভাব টের পাওয়া যাচ্ছিলই। স্রেফ মোদীর টানেই এ দিন হুগলির নানা প্রান্ত এবং বর্ধমান থেকে, গঙ্গা পেরিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার কিছু এলাকা থেকে বিভিন্ন অংশের মানুষ এসে এবং মাঠের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে বিজেপি-র বুকে বল বাড়িয়েছেন! আর রাহুলবাবুরা এ রাজ্যে বিজেপি-কে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন শাসক দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেই। মোদী এ দিন সেই বাধ্যবাধকতাও মাথায় রেখেছেন পুরোদস্তুর। রাহুলবাবুদের আনন্দিত হওয়ারই কথা!

ঠিক তেমনই চিন্তার ভাঁজ বেড়ে যাওয়ার কথা তৃণমূল নেতৃত্বের কপালে! গত কয়েক বছরে বামেদের ভোটব্যাঙ্ক ধসে গিয়ে নতুন প্রজন্ম মূলত মমতার পাশেই দাঁড়িয়েছে। মোদী-মন্ত্র সেই তরুণ প্রজন্মের বড় অংশে ভাগ বসালে শাসক দলের চিন্তিত হওয়ারই কথা। তবে প্রকাশ্যে তাঁরা এ সব ভাবনাকে বিশেষ গুরুত্ব না-দিয়ে মোদীকে পাল্টা আক্রমণেই নেমেছেন। তৃণমূল নেত্রীর নির্দেশে দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন যেমন এ দিন রাতেই বলেছেন, “গুজরাতের দাঙ্গারাজ (একই সঙ্গে দাঙ্গার রাজা ও দাঙ্গার রাজত্ব অর্থে) আকাশ থেকে নেমে এসে বাংলার উন্নয়নের মডেলের কোনও উত্তর খুঁজে পাননি। তাই ব্যক্তিগত আক্রমণে মেতেছেন। দাঙ্গারাজ বলেছেন, দিদি ছবি বেচে ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা পকেটস্থ করেছেন! তিনি এ কথা প্রমাণ করুন, নয়তো মানহানির মামলার মুখে তাঁকে পড়তে হবে!” মমতার ছবি ব্যক্তিগত কোনও লাভের জন্য নয়, বরং নির্বাচনের তহবিল সংগ্রহের জন্য বিক্রি করা হয়েছিল বলে ডেরেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, মোদী ভিত্তিহীন ব্যক্তিগত আক্রমণ করলে তাঁরাও এমন কথা জিগ্গেস করতে পারেন। তাঁর প্রশ্ন, “গুজরাতের দাঙ্গারাজ নিজের স্ত্রীর খোঁজ নেন না। দেশের দায়িত্ব তিনি নেবেন কী ভাবে?”

মোদী অবশ্য এ দিন তৃণমূলের বিরুদ্ধে ব্যাট করেছেন টি-২০’র ঢঙেই! বাম সরকার ৩৪ বছরে রাজ্যের যা ক্ষতি করেছে, মমতা-সরকার ৩৪ মাসে তার থেকেও বেশি অনিষ্ট করেছে বলে কটাক্ষ করেছেন তিনি। সিপিএম এবং কংগ্রেসের সব খারাপ দিক নিয়ে মমতা চলেছেন বলে মন্তব্য করেছেন। পুলিশকে ব্যবহার করে মিথ্যে মামলায় বিরোধীদের ফাঁসানোর চেষ্টা করে জনপ্রিয়তা পাওয়া যাবে না বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। মোদীর কথায়, “মমতাজি’কে আমি সম্মান করি। রাজ্যের মানুষের জন্য অনেক ভাল কিছু আপনি করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির শিকার বানালেন রাজ্যটাকে! এত কুর্সির লোভ আপনার!” ক্ষমতার লোভেই রাজ্যের মানুষের স্বপ্ন তৃণমূল নেত্রী চুরমার করেছেন, এ কথাও বলেছেন মোদী।

যাঁর উদ্দেশে মোদীর এই আক্রমণ, প্রায় কাছাকাছি সময়ে তিনি তখন বক্তৃতা করছিলেন সালকিয়া ও হাওড়া ময়দানের জোড়া সভায়। সেখানে মোদীর গুজরাতকে কটাক্ষ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “সব দিক থেকে ওরা পিছিয়ে! ১০০ দিনের কাজে কী করেছে গুজরাত? কয়েক কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দিয়ে বাজারে কিছু গ্যাস বেলুন ছেড়েছে! এই নির্বাচনে কম করেও পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচা করছে! কিন্তু যারা দাঙ্গা করে, তাদের দেশবাসী চিনে ফেলেছে!”

নদিয়ার কৃষ্ণনগরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বালিতে সূর্যকান্ত মিশ্র বা আলিমুদ্দিনে বিমান বসু, মুরারইয়ে অধীর চৌধুরী সকলেই এ দিন নানা ভাবে প্রশ্ন তুলেছেন সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে তৃণমূলের দহরম-মহরম নিয়ে এবং কেলেঙ্কারির সিবিআই তদন্তে রাজ্য সরকারের আপত্তি নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রীও সিবিআইয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন অব্যাহত রেখেছেন। তৃণমূল নেতা মুকুল রায় আবার বর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরে তির্যক সুরে বলেছেন, “সিবিআই দিয়ে হবে না। আপনারা বরং ইন্টারপোলকে ডাকুন!” ভোটের ফল বেরোনোর পরে কংগ্রেস-বাম-বিজেপি বা সংবাদমাধ্যম, সকলের হিসাব বুঝে নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন মুকুলবাবু।

তবু এ সব তরজাকে এ দিন ছাপিয়ে গিয়েছেন মোদীই। সকালে উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি, দুপুরে ঝাড়খণ্ডের আর একটি সভা সেরে সন্ধ্যায় এসেছিলেন গঙ্গার পশ্চিম পারে শ্রীরামপুরে। বাংলার আবেগ স্পর্শ করতে চেয়েই সেখানে বলে গিয়েছেন, “নেতাজি সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। আমি বলছি, আমাকে সমর্থন করুন, আমি সুরাজ্য দেব!” আরও বলেছেন, “মমতা বা বামেদের নিয়ে কী করবেন, বিধানসভা ভোটে বুঝে নেবেন। এখন ভোটটা আমাকে দিন!”

সভার মূল বক্তা আসার আগে এ দিন দীর্ঘ ক্ষণ ধরে সমাবেশ মাতিয়ে রেখেছিলেন প্রার্থী বাপ্পিই। কখনও চেনা গানের কলি দিয়ে, কখনও পুরোপুরি রাজনীতিকের সুরে। রাজনীতিক বাপ্পি বলেছেন, “শ্রীরামপুরকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। কল-কারখানা বন্ধ, কৃষির অবস্থা ভাল নয়। রাজ্য সরকার যা-ই করুক, লোকসভায় জিতলে এখানকার মানুষের চাহিদা আমি পূরণ করব।” বাবা অপরেশ, মা বাঁশরী লাহিড়ীর কথা বলে বাঙালি ভাবাবেগের সুতো ধরে শ্রীরামপুরে সঙ্গীত অ্যাকাডেমির কথা যেমন বলেছেন, ধর্মীয় পীঠস্থানের উদাহরণ টেনে এলাকায় পর্যটনের উন্নতির সম্ভাবনাও ছুঁয়ে গিয়েছেন।

ভরা ভিড়কে হাত নেড়ে বাপ্পি-মোদীরা যখন বিদায় নিচ্ছেন, বিজেপি-র এক নেতার সহাস্য মন্তব্য, “কথায় আছে, গঙ্গার পশ্চিম কূল, বারাণসী সমতুল!” বারাণসীতে মোদীই তো দাঁড়িয়েছেন!

মমতাজি, যে বাংলায় মা সারদার পুজো হতো, সেই মাকে চিট ফান্ড বানালেন কী ভাবে! আপনার আঁকা ছবি ১ কোটি ৮০ লাখ টাকায় কে কিনল, তা বাংলার মানুষ জানতে চায়।
নরেন্দ্র মোদী

ভিত্তিহীন ব্যক্তিগত আক্রমণ করবেন না। অভিযোগ প্রমাণ করুন, না হলে মানহানির মামলা করব। গুজরাতের দাঙ্গারাজ স্ত্রীর খোঁজ নেন না। দেশের দায়িত্ব নেবেন কী ভাবে?
ডেরেক ও’ব্রায়েন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

goutam banerjee sukanta sarkar lok sabha vote
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE