Advertisement
E-Paper

গোলযোগহীন কুমারগ্রাম ভোটের মুখে থমথমে

প্রায় এক যুগ বিরতির পর ফের স্বমহিমায় ফিরছে কামতাপুরী জঙ্গিরা। পুনর্ভবা পাড়ের হবিবপুর-বামনগোলা থেকে সঙ্কোশ-তীরের কুমারগ্রাম-বারোবিশা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল কেএলও-উপদ্রুত। ভোটের মুখে সরেজমিনে ঘুরে আনন্দবাজারের প্রতিবেদন।আবছা আলোতেও চকচক করছিল কালাশনিকভের কালো নলগুলো। সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে জ্যাকেট আর ডেনিমের শর্টস পরা জনা পাঁচেক অশরীরী যেন হাজির হল মাটি ফুঁড়ে। বিত্তিবাড়ি গ্রামের বড় মুদির দোকানটা থেকে চাল-ডাল-তেল-মশলার রসদ নিয়ে উবে গেল কর্পূরের মতো। ঘটনার সাক্ষী, ওই গ্রামের যুবক কমল সরকার বললেন, “সঙ্কোশ পেরিয়ে এ দিকে আসে কেনাকাটা করতে, তার পর সঙ্কোশ পেরিয়ে চলে যায় অসমে।”

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:১২

আবছা আলোতেও চকচক করছিল কালাশনিকভের কালো নলগুলো। সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে জ্যাকেট আর ডেনিমের শর্টস পরা জনা পাঁচেক অশরীরী যেন হাজির হল মাটি ফুঁড়ে। বিত্তিবাড়ি গ্রামের বড় মুদির দোকানটা থেকে চাল-ডাল-তেল-মশলার রসদ নিয়ে উবে গেল কর্পূরের মতো। ঘটনার সাক্ষী, ওই গ্রামের যুবক কমল সরকার বললেন, “সঙ্কোশ পেরিয়ে এ দিকে আসে কেনাকাটা করতে, তার পর সঙ্কোশ পেরিয়ে চলে যায় অসমে।”

সঙ্কোশ নদী নামে লাইন অফ কন্ট্রোল এই ভাবেই অবলীলায় ভেঙে ফেলেছে জঙ্গিরা!

নদীর এ পারে বিত্তিবাড়ি। পশ্চিমবঙ্গ ওখানেই শেষ। আর নদী পেরোলে ভান্ডারবস্তি। যা অসমের কোকরাঝাড় জেলার গোসাইগাঁও এলাকার অন্তর্গত। নতুন করে নাশকতা শুরু করা কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও)-এর জঙ্গিরা অসম থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়াআসার জন্য যে ঘন ঘন কুমারগ্রাম ব্লকের বিত্তিবাড়ির জঙ্গলপথ ব্যবহার করছে, সে কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র দফতরে জমা পড়া রাজ্য গোয়েন্দা শাখা (আইবি)-র রিপোর্টেই।

বিত্তিবাড়ির পরেই জ্বালানি আর রায়মানার জঙ্গল। এর মধ্যে রায়মানা আবার অসমের বড়ো জঙ্গিদের (এনডিএফবি) শক্ত ও পুরনো ঘাঁটি। এ বার, তাদের এই পুনরুত্থানের পর্যায়ে কেএলও অনেকটাই সাহায্য পাচ্ছে এনডিএফবি-র কাছ থেকে। স্থানীয় বাসিন্দারাও একমত, এনডিএফবি-র বলে বলীয়ান হয়েই কেএলও জঙ্গিরা অসম থেকে জঙ্গলপথে সঙ্কোশ পেরিয়ে বিত্তিবাড়ি এবং বিত্তিবাড়ি থেকে মাঝেমধ্যে মধ্য হলদিবাড়িতে ঢুকে পড়ছে।

বাসিন্দাদের বক্তব্য, চাল-ডাল-বিড়ি-খৈনি-পান কেনার জন্য রায়মানা, জ্বালানির জঙ্গল থেকে সব চেয়ে কাছের জায়গা বিত্তিবাড়ি। ফলে, রসদ সংগ্রহের জন্য বিত্তিবাড়িতে না এসে উপায় নেই জঙ্গিদের। বিত্তিবাড়ির একাধিক ব্যবসায়ীর সাফ কথা, “জঙ্গি হোক কিংবা ডাকাত, ওদের না বলি কী করে? ওরা তো খদ্দের।”

জলপাইগুড়ির বজরাপাড়ায় বিস্ফোরণের পর থেকে এই তল্লাটে পুলিশি টহলদারি চলছে নিয়মিত। সেই সঙ্গে বারোবিশা চৌপথি, ঘোড়ামারা সেতুর মতো কুমারগ্রামে ঢোকা-বেরোনোর ছোট-বড় সব ধরনের রাস্তাতেই পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর প্রহরা। তবু অন্ধকার নামার পর অসমের দিক থেকে সঙ্কোশ পেরিয়ে কুমারগ্রামে জঙ্গিদের নিয়মিত অনুপ্রবেশ বন্ধ করা যায়নি।

সিপিএমের কুমারগ্রাম জোনাল কমিটির সদস্য পিন্টু গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, “কুমারগ্রামকে ঘিরে থাকা বিভিন্ন জঙ্গল ও নদীর চর জঙ্গিদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছে।”

এই অবস্থায় রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের (আইবি) আশঙ্কা, লোকসভা ভোটের মুখে আলিপুরদুয়ার লাগোয়া কোনও এলাকায় বড়সড় কোনও হামলা চালাবে কেএলও। এবং তারা নাকি আসবে এই কুমারগ্রামের রাস্তা ধরেই।

অতএব মাঝখানে কয়েক বছর বিরতির পর কুমারগ্রামের নাড়িতে ফের একই রকম স্পন্দন। এক যুগ আগের মতো।

নয়ের দশকের শেষ দিকে শুরু হওয়া কেএলও-র সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের আঁতুড়ঘর ছিল ডুয়ার্সের এই জনপদ। ২০০৩-এর ডিসেম্বরে ভুটানে জঙ্গি দমনে হওয়া সেনা অভিযান ‘অপারেশন ফ্লাশ আউট’ পর্যন্ত কুমারগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল সন্ত্রাস শব্দটা। কুমারগ্রাম তখন এতটাই উপদ্রুত যে মোটর বাইকে চড়ে থানার ওসি বাসুদেব সরকার এলাকায় টহল দিতেন দু’কাঁধে দু’টি কালাশনিকভ রাইফেল নিয়ে।

কুমারগ্রাম চৌপথি থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ভুটানের কালীখোলায় ছিল কেএলও-র সশস্ত্র শিবির। যখন-তখন শিবির থেকে নেমে কুমারগ্রামের মহল্লায় মহল্লায় ছড়িয়ে যেত জঙ্গিরা। তা ছাড়া, জীবন সিংহ, হর্ষবর্ধন, মিল্টন বর্মার মতো কেএলও-র তদানীন্তন শীর্ষ নেতারা সকলেই ছিলেন কুমারগ্রামের ছেলে। তখনকার শাসকদল সিপিএম ও আরএসপি-র বেশ কয়েক জন নেতা তখন কুমারগ্রামে কেএলও জঙ্গিদের হাতে খুন হন। পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ওই তল্লাটে তখন কেএলও জঙ্গিদের ‘এনকাউন্টার’ প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা।

২০০২-এর সেই উত্তপ্ত সময়েই কালীখোলা থেকে সঙ্কোশের শাখা, শুখা নদী পেরিয়ে কুমারগ্রামে পৌঁছেছিল আলফা-কেএলও-র ৮৫ জনের যৌথ বাহিনী। যাদের অন্তত ১৫ জনের হাতে ছিল রকেট লঞ্চার আর বাকিদের প্রত্যেকের কাছে সাব-মেশিনগান। আলফা-র পরিকল্পনা ছিল, পুলিশ ওই জায়গায় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে কুমারগ্রাম থানাটাই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হবে।

কিন্তু সে কথা জানা মাত্র বাদ সাধলেন কেএলও-র তদানীন্তন কমান্ডার-ইন-চিফ মিল্টন বর্মা, যিনি আসলে কুমারগ্রামের উত্তর হলদিবাড়ির মিহির দাস। মিল্টন সাফ জানিয়ে দেন, থানা ধ্বংস করলে গোটা কুমারগ্রাম জুড়ে নিরাপত্তার কড়াকড়ি এতটাই হবে যে ওই এলাকা আর কেএলও-র নিরাপদ আশ্রয় থাকবে না। মিল্টন পরামর্শ দেন, গুপ্তহত্যা চলছে চলুক, কিন্তু এই ধরনের বড়সড় হামলা কখনও কুমারগ্রামে করা চলবে না। পত্রপাঠ ভুটানে ফিরে যায় আলফা-কেএলও-র সেই যৌথ বাহিনী।

আর ১২ বছর পরে কুমারগ্রামের চার পাশের জঙ্গল এলাকার অনেকটা জুড়ে কেএলও মুক্তাঞ্চল তৈরি করে ফেললেও ওই একই কারণে সেখানে বড়সড় হামলা করছে না কেএলও। রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তার কথায়, “কেএলও-র কাছে কুমারগ্রাম ‘অপারেশনাল জোন’ নয়, বরং প্রিয় ‘রুট’। খামোখা পুলিশকে ঘাঁটিয়ে ওই পথকে ওরা নষ্ট করতে যাবে কেন?”

হক কথা। রাজবংশী সম্প্রদায় প্রভাবিত এই জনপদের জীবনযাত্রায় কোনও বিঘ্ন ঘটেছে বলে মনে হল না। বাজারহাটে বিকিকিনি, যানবাহন চলাচল সব-ই স্বাভাবিক। সূর্য ডোবার পরেও জনজীবন সচল। কিন্তু কোথায় যেন অস্বস্তির তিরতিরে স্রোত।

সঙ্কোশ তীরবর্তী মধ্য হলদিবাড়ি গ্রামের ভীম রায়, সঞ্জয় রায়রা অচেনা মুখ দেখলে পাঁচ-ছ’জন একজোট হয়ে তবেই কথা বলতে এগিয়ে আসেন।

সেই সময়ে তাঁদের মুখমণ্ডল আর এ বার ভোটের মুখে কুমারগ্রামের পরিবেশ সম্পর্কে একই বিশেষণ প্রযোজ্য। থমথমে।

(চলবে)

surbek biswas klo
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy