Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ঘুম পেলেই পিঠে পড়ত লাঠি

কলকাতায় গেঞ্জি কারখানায় কাজ দেওয়ার নাম করে মাস পাঁচেক আগে পুরুলিয়ার মানবাজার ও বোরো থানা এলাকার ১৩ জন শিশু শ্রমিককে রাজস্থানের জয়পুরে একটি জরির কারখানায় পাচার করার অভিযোগ সম্প্রতি সামনে আসে। সেখান থেকে অসুস্থ এক নাবালক বাড়ির পথে ট্রেনেই মারা যায়। নড়েচড়ে বসে পুলিশ। শিশু দিবসের দিনেই বাড়ি ফিরল সেই শিশু শ্রমিকরা। তাদেরই এক জনের কথা।কলকাতায় গেঞ্জি কারখানায় কাজ দেওয়ার নাম করে মাস পাঁচেক আগে পুরুলিয়ার মানবাজার ও বোরো থানা এলাকার ১৩ জন শিশু শ্রমিককে রাজস্থানের জয়পুরে একটি জরির কারখানায় পাচার করার অভিযোগ সম্প্রতি সামনে আসে। সেখান থেকে অসুস্থ এক নাবালক বাড়ির পথে ট্রেনেই মারা যায়। নড়েচড়ে বসে পুলিশ। শিশু দিবসের দিনেই বাড়ি ফিরল সেই শিশু শ্রমিকরা। তাদেরই এক জনের কথা।

তপন শবর (১৬ বছর)
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৭
Share: Save:

সূঁচ-সুতো নিয়ে বসতেই মালিক গুড্ডু খান আমার পিঠে দমাস করে লাঠির বাড়ি মারল। যন্ত্রণায় চিৎকার করতেই আরও কয়েক ঘা। সঙ্গে হুমকি, ‘আর যদি দেরি করিস তাহলে এ বার মেরেই ফেলব তোকে’। কী অপরাধ করেছিলাম? ক’দিন ধরে মাথা ব্যথায় মরে যাচ্ছিলাম। ঘুম ভাঙতে তাই বেলা হয়েছিল। সেই মারের দাগ এখনও পিঠে রয়েছে। ডান হাতটা তুলতে গেলে ব্যথা লাগে।

জয়পুরে বিরাট পাঁচিল ঘেরা একটা বাড়ির মধ্যে আমাদের গত জুন থেকে আটকে রেখে গুড্ডু জরির কাজ করাত। সকাল ন’টা থেকে রাত ২টো-তিনটে পর্যন্ত কাজ চলত। লাঠি, রড হাতে আমাদের নজরে রাখত দু’জন ষন্ডা মার্কা লোক। কাজে একটু ঢিলেমি দেখলে তারা মারধর করত। মাস খানেক আগে আমাদের গ্রাম মানবাজারের কাশীডির ন’বছরের ছেলে আকাশ রাতে কাজ করার সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। গুড্ডু ওর মাথাটা দেওয়ালে সজোরে ঠুকে দেয়। ক’দিন ধরে যন্ত্রণায় ছেলেটা কাবু হয়ে ছিল।

১৬ জুন বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে এ সব ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। শুনেছি পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরে গুড্ডুর বাড়ি। এলাকার একজনের সঙ্গে গুড্ডু গ্রামে এসে জানিয়েছিল, কলকাতায় ওর গেঞ্জি কারখানায় ছেলে দরকার। খাওয়া-পরার সঙ্গে দিনে ১০০ টাকা করে মজুরি দেবে। কাশীডি থেকে ছ’জন ও বোরো থানার ওলগাড়া গ্রামের আটজন গুড্ডুর সঙ্গে বেরিয়ে আসানসোল থেকে ট্রেনে চাপি। পরে যাত্রীদের কাছে জানতে পারি ট্রেনটা কলকাতা নয়, জয়পুরে যাচ্ছে। গুড্ডু আমাদের ধমকে চুপ করিয়ে দেয়। তখনই বুঝি বিপদে পড়েছি।

প্রথম দিনেই গুড্ডু বুঝিয়ে দিয়েছিল, ওর কথা না শুনলে কপালে বিপদ আছে। টানা বসে কাজ করায় চোখ জ্বলত, পিঠ ব্যথা করত। ঘুমে এলিয়ে পড়লেই চুলের মুঠি ধরে টেনে কাজে বসিয়ে দিত। ভাবতাম এখান থেকে বোধহয় বেরোতে পারব না। দুপুরে আধ ঘণ্টা খাবার জন্য আমাদের ছুটি মিলত। ভাত, ডাল আর একটা সব্জি ছাড়া বাড়তি কিছুই দিত না। বেশি খেলে বলত, ঘুমিয়ে পড়ব। আবার কম খেলেও জ্বালা! বলত, দুর্বল হয়ে পড়ব। স্থানীয় কয়েকজন কাজ করলেও তারা কাজের পরে বাড়ি চলে যেত।

বাড়ির লোকেরা অবশ্য আমাদের দুর্দশার কথা জানতে পারেনি। গুড্ডু মাঝে মধ্যে বাড়ির লোককে ফোনে ধরিয়ে দিয়ে ভয় দেখিয়ে আমাদের ‘ভাল আছি’ বলতে বাধ্য করাত। এর মধ্যে আমাদের দলের নিতাই শবর মাঝেমধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ছিল। কালীপুজোর আগে ওর বাবা বিশ্বনাথ শবর গুড্ডুকে কোনওরকমে বুঝিয়ে বাড়ি যাওয়ার ছুটি পায়। কিন্তু সে নিতাইকে আটকে রাখে। নিতাই আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু ওকে ডাক্তার দেখানো হয়নি। উল্টে রাজীব শবরকে দিয়ে নিতাইকে ক’দিন আগে বাড়ির ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়। সে যে ট্রেনেই মারা যাবে ভাবতে পারিনি।

ক’দিন আগে গুড্ডুর কথা মতো, বাড়ির লোক ও পুলিশকে ফোন করে মিথ্যা জানাই, ‘আমরা ভাল আছি’। পুলিশের চাপে গুড্ডু শেষে বুধবার আমাদের নিয়ে ট্রেনে ওঠে। এতদিন কাজের জন্য প্রত্যেককে মাত্র ১০০০ টাকা দিয়ে সে ধানবাদে ট্রেন থেকে নেমে যায়। আসানসোলে গভীর রাতে নেমে দেখি প্রচুর পুলিশ দাঁড়িয়ে। তারা আমাদের গাড়িতে তুলে বাড়ি নিয়ে এলো। এখন গুড্ডুকে পুলিশ ধরে সাজা দিলে তবেই জ্বালা জুড়োবে। নিতাই যেখানেই থাকুক, ও শান্তি পাবে।

অনুলিখন: সমীর দত্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

child labour tapan shabar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE