Advertisement
০৬ মে ২০২৪

চেনা বলেই কি মঞ্চে দেবাশিস, প্রশ্ন দলেও

খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো। তৃণমূলে এই মুহূর্তে যিনি কার্যত দু’নম্বরের মর্যাদা পাচ্ছেন বলে দলের মধ্যেই গুঞ্জন। এ হেন ‘হাই প্রোফাইল’ নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতামঞ্চে দেবাশিস আচার্যের মতো অনাহূতকে উঠতে দেওয়া হল কী ভাবে, সেই সংশয় ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে। অনেকেরই প্রশ্ন, পরিচিত মুখ না-হলে দেবাশিসের পক্ষে রবিবার চণ্ডীপুরে অভিষেকের সভামঞ্চের ধারে-কাছে যাওয়া সম্ভব ছিল কি?

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৮
Share: Save:

খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো। তৃণমূলে এই মুহূর্তে যিনি কার্যত দু’নম্বরের মর্যাদা পাচ্ছেন বলে দলের মধ্যেই গুঞ্জন। এ হেন ‘হাই প্রোফাইল’ নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতামঞ্চে দেবাশিস আচার্যের মতো অনাহূতকে উঠতে দেওয়া হল কী ভাবে, সেই সংশয় ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে। অনেকেরই প্রশ্ন, পরিচিত মুখ না-হলে দেবাশিসের পক্ষে রবিবার চণ্ডীপুরে অভিষেকের সভামঞ্চের ধারে-কাছে যাওয়া সম্ভব ছিল কি?

শুধু বিরোধী মহলে নয়, তৃণমূলের অন্দরেও প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। উপরন্তু চড়-কাণ্ডের পুলিশি তদন্তে ‘চেনা মুখের’ ব্যাপারটা গুরুত্ব না-পাওয়ায় সন্দেহ আরও দানা বেঁধেছে। ঘটনার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তৃণমূলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের সুরও অনেক সময়ে মিলছে না।

রবিবার চণ্ডীপুরের সভা-মঞ্চে উঠে তৃণমূল যুব সভাপতি অভিষেককে চড় মারেন দেবাশিস। তাৎক্ষণিক বিভ্রান্তি কাটানোর পরে তৃণমূলের কিছু নেতা বিবৃতি দেন, ঘটনার পিছনে ‘ধর্মান্ধ ও বিভেদকামী শক্তি’র হাত রয়েছে। কেউ সরাসরি বিজেপি’র দিকে আঙুল তোলেন। বিজেপি’র ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)-এর সঙ্গে দেবাশিসের সংশ্রবের তথ্য তুলে ধরেছে পুলিশও। অন্য দিকে এবিভিপি নেতৃত্বের পাল্টা ইঙ্গিত, রবিবারের ঘটনাটি আসলে তৃণমূলের ভিতরকার টানাপড়েনেরই বহিঃপ্রকাশ। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক সুবীর হালদার মঙ্গলবার বলেন, “দেবাশিস আচার্য আমাদের কেউ নন। ওঁর মা সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, ওঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পছন্দ করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারীর ছবি বাড়িতে রাখেন।”

এবং যা বোঝার, এই সব তথ্যই বুঝিয়ে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন সুবীরবাবু। পূর্ব মেদিনীপুরের তৃণমূল নেতাদের একাংশও চড়-কাণ্ডে ‘বিজেপি সংশ্রবের’ মতো সরল সমীকরণে বিশ্বাসী নন। ওঁদের বক্তব্য: দলে এখন বলতে গেলে নেত্রীর পরেই অভিষেকের গুরুত্ব। তাঁর সভায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট আঁটোসাটো থাকাটাই স্বাভাবিক। এমনকী, সরকারি পরিচয়পত্রধারী সাংবাদিকদেরও ইদানীং যে কোনও সভামঞ্চে হুট-হাট উঠতে দেওয়া হয় না। আর দলীয় বৃত্তে অপরিচিত কাউকে সভা-মঞ্চে উঠতে দেওয়া দূরের কথা, আশপাশেই ঘেঁষতে দেন না দলের স্বেচ্ছাসেবকেরা। এমতাবস্থায় দেবাশিস বিনা বাধায় যে ভাবে মঞ্চে উঠে একেবারে অভিষেকের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন, তাকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে মানতে নারাজ রবিবারের সভায় উপস্থিত থাকা তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বড় একটা অংশ। এঁদের কেউ কেউ পুরো ঘটনায় চক্রান্তের গন্ধও পাচ্ছেন।

এ দিকে চণ্ডীপুরের ঘটনার জন্য তৃণমূলের অভ্যন্তরে তাঁদের দিকেও আঙুল উঠতে পারে আশঙ্কা করে অধিকারী শিবিরও বিস্তারিত খোঁজ-খবর করেছে। জেলার ওই শিবিরের এক নেতা বলছেন, “মনে হচ্ছে, ধর্মীয় বা অধ্যাত্মবাদী শিক্ষায় অনুপ্রাণিত ও বিকারগ্রস্ত হয়েই ছেলেটি এমন কাণ্ড করেছে। এর মধ্যে তৃণমূলের কোনও অংশের হাত থাকার জল্পনা একেবারেই অমূলক।” রবিবারের সভার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন যিনি, চণ্ডীপুরের সেই তৃণমূল বিধায়ক অমিয় ভট্টাচার্যেরও দাবি, চক্রান্তের সন্দেহ ভিত্তিহীন। “এমন অনেক উৎসাহী যুবক আমাদের সমর্থক, যাঁরা এই ধরনের সভায় নেতাদের ছবি তোলার জন্য মঞ্চে উঠে পড়েন। ওই ছেলেটিও ছবি তোলার জন্য উঠছে ভেবে কেউ তাঁকে যেতে দিয়েছিলেন।” এ দিন ব্যাখ্যা দিয়েছেন অমিয়বাবু। পাশাপাশি বলেছেন, “আমি জেনেছি, এক নিরাপত্তারক্ষী শেষ মুহূর্তে যুবকটির দিকে হাত বাড়িয়ে আটকাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু যুবকটি দ্রুত এগিয়ে যাওয়ায় আটকাতে পারেননি। ব্যাপারটা আচমকাই ঘটেছে।”

তৃণমূলের এই জাতীয় সভা পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত পশ্চিম মেদিনীপুরের এক নেতা অবশ্য অমিয়বাবুদের ব্যাখ্যা শুনে সন্তুষ্ট নন। উনি বলছেন, “কলকাতা থেকে কোনও বড় মাপের নেতা, স্থানীয় সাংসদ বা মন্ত্রীরা সভা করার সময়ে মঞ্চ ঘিরে দলীয় স্বেচ্ছাসেবকদের একাধিক বলয় থাকে। তা উপেক্ষা করে যে কেউ মঞ্চের কাছে পৌঁছে যেতে পারে না।” ওঁর স্পষ্ট উপলব্ধি, “হয় মেনে নিতে হবে যে, সভার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিকঠাক ছিল না। নতুবা ধরে নিতে হবে, চেনা বলেই দেবাশিসকে মঞ্চের কাছে যেতে দেওয়া হয়েছে।”

বস্তুত এ দিন চড়-কাণ্ড প্রসঙ্গে বিভিন্ন মহলে এই ‘চেনা মুখের’ তত্ত্বই ঘুরে-ফিরে এসেছে। “ছেলেটি স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের পরিচিত না-হলে কী ভাবে মঞ্চে উঠতে পারলেন?” প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী তথা কলকাতার প্রাক্তন সিপিএম মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। তাঁর পর্যবেক্ষণ, “পুলিশের সামনেই ওঁকে মঞ্চে উঠতে দেওয়া হয়েছে। আমার অনুমান, এর পিছনে রয়েছে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব।” আর তৃণমূল যে রকম দল, সেখানে এমনটা হতেই পারে বলে মনে করছেন আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ। তাঁর কথায়, “তৃণমূল এমন একটা দল, যেখানে সকলেই নেতা! শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চে উঠলে নিরাপত্তার কারণে কিছুটা কড়াকড়ি হয়। অন্য সময় সে সবের বালাই থাকে না। রবিবারেও ছিল না।” কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান এ জন্য তৃণমূলের সংস্কৃতিকেই দায়ী করেছেন। “মুখ্যমন্ত্রীই তো বলেছিলেন, পুলিশকে চড় মারবেন! বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার রাতের বেলায় কোনও নাগরিককে ধমক দিচ্ছেন!” প্রতিক্রিয়া মান্নানের। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর ধারণা, জেনে বা না-বুঝে কেউ ছেলেটিকে মঞ্চে উঠতে দিয়েছে।

তবে কলকাতা শহরে বড় বড় রাজনৈতিক সভা নিয়ন্ত্রণ করা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারেরা কেউ কেউ মনে করছেন, রবিবার চণ্ডীপুরের সভায় পুলিশ নিজেদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করলে এমনটি হয়তো ঘটত না। সভায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথাযথ ছিল কি?

জানতে চাওয়া হলে পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সুকেশ জৈন এ দিন বলেন, “তদন্ত চলছে। এখন কিছু বলা যাবে না।” রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন জানিয়েছেন, যুব সভাপতির নিরাপত্তা-বন্দোবস্তে কোনও গাফিলতি ছিল কি না, প্রশাসনিক তদন্তেই তা যাচাই হবে। পার্থবাবুর অবশ্য দাবি, দেবাশিসকে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি ভেবেই মঞ্চে উঠতে দেওয়া হয়েছিল। কেউ ঘুণাক্ষরে ভাবেনি, এমন কাণ্ড ঘটতে পারে! পাশাপাশি বিজেপি-র উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে পার্থবাবু বলছেন, “বিজেপি যে কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করাক। ছেলেটি কে, কী উদ্দেশ্যে এই কাজ করেছে, সব খুঁজে বার করা হোক।”

বিজেপি কি চ্যালেঞ্জ নেবে?

বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের জবাব, “এক জন মন্ত্রী হিসেবে পার্থবাবুর জানা উচিত, কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করাতে হলে রাজ্য সরকারের অনুমতি লাগে। এই তদন্ত যদি ওঁদের পক্ষে যায়, তো করান!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE