আদালতে তোলা হচ্ছে জিয়াউলকে।—নিজস্ব চিত্র।
তদন্তে নামার প্রায় এক মাসের মাথায়, শুক্রবার, বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে নিজেরাই প্রথম কারওকে গ্রেফতার করল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা।
এ দিন এনআইএ-র হাতে গ্রেফতার হওয়া বছর পঁয়ত্রিশের জিয়াউল হক পেশায় হাইস্কুল শিক্ষক, তাঁর বাড়ি মালদহের কালিয়াচক এলাকার পুরনো গুরুতলার ষোলো মাইলে। জিয়াউলের বাবা ফাইমুদ্দিন শেখ কালিয়াচকের নাসিরটোলা প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বর্ধমানের খাগড়াগড়ের মসজিদ তালাওয়ে দু’বছর ভাড়া ছিলেন জিয়াউল। বিস্ফোরণস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে ওই বাড়ি। আর সেখান থেকেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয় বলে এনআইএ দাবি করেছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সীমান্ত পেরিয়ে গিয়ে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর জঙ্গি শিবিরে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা জিয়াউল বর্ধমানের শিমুলিয়া ও মুর্শিদাবাদের মুকিমনগর মাদ্রাসায় এক দল পুরুষ ও মহিলাকে জেহাদি ভাবধারায় দীক্ষা দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন।
এনআইএ-র এক অফিসার বলেন, “আমরা যাঁদের খুঁজছি, তাঁদের সঙ্গে জিয়াউলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। জেএমবি-র সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথাও জেরায় জানিয়েছেন জিয়াউল।” আজ, শনিবার জিয়াউল হককে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে হাজির করানোর কথা। গত ৩১ অক্টোবর এনআইএ খাগড়াগড় কাণ্ডে ১২ জন পলাতক অভিযুক্তের হদিস পেতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে। সেই তালিকায় কিন্তু জিয়াউলের নাম নেই।
তবে ওই তালিকায় নাম রয়েছে অসমের বরপেটা জেলার চতলা গ্রামের কোয়াক ডাক্তার শাহনুর আলমের। শাহনুর ধরা না পড়লেও তার স্ত্রী সুজানা বেগমকে গুয়াহাটি সিটি পুলিশ সেখানকার আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাস থেকে বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার করেছে। সুজানাকে যখন গ্রেফতার করা হয়, তখন ওই মহিলার কোলে তাঁর দেড় বছরের ছেলে। সুজানাকে এনআইএ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। সুজানার স্বামী শাহনুর আলমের হদিস পেতে এনআইএ পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। এনআইএ-র দাবি, সুজানা নিজে প্রশিক্ষিত জঙ্গি তো বটেই, সেই সঙ্গে তিনি বরপেটা থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসে মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া ও লালগোলার মুকিমনগর মাদ্রাসায় মহিলা জঙ্গিদের প্রশিক্ষণও দিতেন। তদন্তকারীদের বক্তব্য, খাগড়াগড় কাণ্ডে ফেরার সাজিদের স্ত্রী ফতেমা বিবি ও আর এক ফেরার ইউসুফ শেখের স্ত্রী আয়েষা বিবির মতো সুজানাও প্রমীলা জঙ্গি বাহিনীর প্রশিক্ষক ছিল।
সেই প্রমীলা জঙ্গি বাহিনীর দুই সদস্য রাজিয়া বিবি ও আলিমা বিবি-সহ চার জনকে জেরা করে এনআইএ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলেও তাদের গ্রেফতার করেছিল পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। এনআইএ প্রথম কাউকে গ্রেফতার করল তদন্তে নামার ২৮ দিনের মাথায়। তবে এনআইএ-র বক্তব্য, তাদের হাতে গ্রেফতার হওয়া জিয়াউল জঙ্গি মডিউলে বাকি চার ধৃতের চেয়ে কিছুটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
কেন? গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, প্রথমত, তালিত স্টেশন লাগোয়া বর্ধমান-সিউড়ি রোডের তালিত গৌড়েশ্বর হাইস্কুলের আরবি ভাষার শিক্ষক জিয়াউল শুধু জঙ্গি নন, ছিলেন জেহাদি ভাবধারার অন্যতম প্রধান প্রচারক ও প্রশিক্ষকও। খাগড়াগড় কাণ্ডে ফেরার জেএমবি-র কমান্ডার সাজিদ ও সাকিব ওরফে সুমন তো বটেই, ওই জঙ্গি সংগঠনের অন্য চাঁইদের সঙ্গে জিয়াউলের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল বলে এনআইএ মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে জানতে পেরেছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যাতায়াত ছিল জিয়াউলের।
জিয়াউলের মেজ ভাই সাইদ বলেন, “দাদা বাড়িতে শেষ এসেছিল ১ নভেম্বর। ৪ নভেম্বর সকালে বাসে করে সস্ত্রীক বাড়ি থেকে ফরাক্কা যায়। সেখান থেকে বালুরঘাট এক্সপ্রেস ধরে বর্ধমান রওনা হয়।” সাইদের বক্তব্য, “৪ নভেম্বর সকাল থেকে দাদার সঙ্গে আমাদের কারও আর কোনও যোগাযোগ হয়নি। আমরা ভেবেছিলাম ওদের কেউ অপহরণ করেছে। বৃহস্পতিবার সকালে কালিয়াচক থানায় আমরা নিখোঁজ ডায়েরি করি।” তার পর শুক্রবার বিকেলে জিয়াউলকে গ্রেফতার করার কথা ঘোষণা করে এনআইএ। সূত্রের খবর, ৪ তারিখ বর্ধমান স্টেশন থেকেই জিয়াউলকে সপরিবারে আটক করেছিল এনআইএ এবং তার পর সেচ দফতরের বাংলোয় নিয়ে গিয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এ দিন দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ এনআইএ-র কয়েক জন অফিসার ও জেলা পুলিশের একটি দল জিয়াউলের বাড়িতে গিয়ে ল্যাপটপ কোথায় আছে, তা জানতে চান। কিন্তু বাড়িতে ল্যাপটপ ছিল না। বৈষ্ণবনগর থানার পাশে, জিয়াউলের বন্ধু এনামুল হকের হার্ডঅয়্যারের দোকান থেকে ওই ল্যাপটপ উদ্ধার করেন তদন্তকারীরা।
এনআইএ সূত্রের খবর, জঙ্গিদের অন্যতম চাঁই, মঙ্গলকোটের কৃষ্ণবাটী গ্রামের ইউসুফ শেখ এবং বাদশাহী রোডের রেজাউল করিমেরও ঘনিষ্ঠ এই জিয়াউল। ওই রেজাউল করিমের বাড়ি থেকেই ৩৫টি গ্রেনেড ও ৪টি সকেট বোমা এনএসজি-র সহায়তায় উদ্ধার করেছিল এনআইএ। এনআইএ জানিয়েছে, গুজরাত ও অসমের গোষ্ঠী সংঘর্ষ এবং বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সংক্রান্ত জেহাদি ভিডিও টেপ দেখিয়ে শিমুলিয়া ও মুকিমনগর মাদ্রাসায় পুরুষ ও মহিলা শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতেন জিয়াউল। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মহিলারাও থাকতেন বলে তাঁদের সামনে জিয়াউল আসতেন না। পর্দার ঘেরাটোপে থেকে তিনি কথা বলতেন বলে জেনেছে এনআইএ। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর জিয়াউলকে ল্যাপটপ দিয়েছিল বাদশাহী রোডের সেই রেজাউল করিম। রেজাউলও পলাতক। ওই ল্যাপটপের ফরেন্সিক পরীক্ষার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এ দিন সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ এনআইএ-র পাঁচ-ছ’জন অফিসার ও বর্ধমান পুলিশের একটি দল জিয়াউলকে বর্ধমানের সিজেএম আদালতে হাজির করান। তার আগেই বিশাল পুলিশ বাহিনী আদালত চত্বর ঘিরে ফেলেছিল। বিচারকের নির্দেশে জিয়াউলকে ‘ট্রানজিট রিমান্ড’-এ পায় এনআইএ। জিয়াউলের মুখ ছিল কালো কাপড়ে ঢাকা, শুধু চোখ দু’টি বেরিয়ে ছিল। পাঁচ ফুট উচ্চতা, গাঁট্টাগোট্টা চেহারার জিয়াউলের পরনে ছিল আকাশি জামা, নস্যি ট্রাউজার। খাগড়াগড় কাণ্ডের তিন-চার দিন পরেও এলাকায় দেখা গিয়েছে তাকে। এমনকী এনআইএ এবং এনএসজি যখন তল্লাশি চালায়, তখনও ওই এলাকায় ছিলেন জিয়াউল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy