Advertisement
০৩ মে ২০২৪

জামাতের হুমকি ভুলে সীমান্তে ভিড় পড়ুয়াদের

সারা রাত ঘুম হয়নি যশোহরের নবম শ্রেণির মায়ারা খাতুনের বাবা-মায়ের। শওকত আর রাজিয়া বারবার মেয়েকে বোঝাচ্ছিলেন, “দেশ অস্থির, এ বার একুশেটা না হয় ছেড়ে দে মা।” কিন্তু মেয়ে নাছোড়। বাগ মানানো যায়নি মায়ারার মতোই আরও কয়েকশো ছেলেমেয়েকে। যশোহর, খুলনার এই পড়ুয়ারা সকাল সকাল চুলে ফুল, কপালে টিপ আর গালে দেশের পতাকা এঁকে ভিড় করেছিল বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে। বেনাপোল ডিগ্রি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী রুমান আখতার যেমন বলল, ‘‘আমরা দু’শো জন এসেছি।

হাজির পড়ুয়ারা। শনিবার বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

হাজির পড়ুয়ারা। শনিবার বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও সীমান্ত মৈত্র
বেনাপোল ও পেট্রাপোল শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৫৫
Share: Save:

সারা রাত ঘুম হয়নি যশোহরের নবম শ্রেণির মায়ারা খাতুনের বাবা-মায়ের। শওকত আর রাজিয়া বারবার মেয়েকে বোঝাচ্ছিলেন, “দেশ অস্থির, এ বার একুশেটা না হয় ছেড়ে দে মা।”

কিন্তু মেয়ে নাছোড়। বাগ মানানো যায়নি মায়ারার মতোই আরও কয়েকশো ছেলেমেয়েকে। যশোহর, খুলনার এই পড়ুয়ারা সকাল সকাল চুলে ফুল, কপালে টিপ আর গালে দেশের পতাকা এঁকে ভিড় করেছিল বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে। বেনাপোল ডিগ্রি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী রুমান আখতার যেমন বলল, ‘‘আমরা দু’শো জন এসেছি। বোমা মারলে না হয় মরে যাব, তার আগে তো মরব না।” যশোহরের মাধবপুর-সোনাপুর এলাকারই কয়েকশো স্কুল-কলেজ পড়ুয়া এ দিন হাজির ছিল বেনাপোলে।

এ বার আসা সহজ ছিল না। বিএনপি-জামাত সমর্থকরা নিত্য হামলা চালাচ্ছে বাস ট্রেনের উপরে। পেট্রোল বোমা হামলায় মারা গিয়েছেন একশোরও বেশি যাত্রী। ফলে দূরপাল্লার বাস কার্যত বন্ধ। যশোর, খুলনা থেকে যে ছাত্রছাত্রীরা এসেছে বেনাপোলে, তারা দীর্ঘ ক্ষণ দাঁড়িয়ে বাস পেয়েছে। তারা বেবি ট্যাক্সি (বড়ো অটো) চড়ে ঠাসাঠাসি করে এসেছে বেনাপোলে। তার পর দেড়-দুই কিলোমিটার হেঁটে এসেছে সীমান্তে। তা সত্ত্বেও বেনাপোলে অন্য বছরের তুলনায় লোক কিছু কম জমেনি, বরং বেশিই।

এ পারের দৃশ্যও কম উদ্বেগজনক নয়। পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ছ’হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে অর্ধেকে। একুশে সকালে পেট্রেপোল বন্দরে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েকশো মানুষ। সপ্তাহে মাত্র দু’দিন ও পারে যাওয়ার ছাড় মিলছে, তাই প্রতিদিন লম্বা হচ্ছে লাইন। অভিবাসন দফতরের এক কর্তা বললেন, “ও দেশের সরকার যদি না ছাড়ে, আমরা ছাড় দেব কী ভাবে?” প্রায় ৩০০ জনের পরে দাঁড়িয়ে গোলাম মাসুদ। কোলের শিশুটিকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়। বললেন, “যেখানে-সেখানে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ছে। এখন ঘরে ফিরতে চাই। জীবনটা আগে, পরে একুশে।”

সীমান্তে যখন এমন উদ্বেগ আর আতঙ্ক, তখন পেট্রাপোলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক বলছিলেন, “আত্মার সম্পর্ক দেশভাগ দিয়ে মোছা যায় না।” ভাষা দিবসে বেনাপোল-পেট্রাপোলে এই প্রথম এসে আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। বেনাপোলের মেয়র আশরাফুল আলম লিটন দীর্ঘদিন ধরে বেনাপোলে একুশের অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা। এদেশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “‘আমরা জুলুমের সঙ্গে থাকতে চাই না, শান্তিতে থাকতে চাই।”

ফুলে ফুলে ঢাকা ভাষা শহিদ মিনার। একুশে ফেব্রুয়ারি, ঢাকায়। ছবি: বাপি রায়চৌধুরী।

এ বার জনা ত্রিশেক কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীকে ছাড় দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশে যেতে। সকাল আটটা নাগাদ এ পার বাংলার নবীন সঙ্গীতশিল্পী, কবিদের অনুষ্ঠানে মেতে উঠল বেনাপোলের কয়েক হাজার মানুষ। বেলা ১০টা নাগাদ এ দেশ থেকে আরও ২৫ জনের একটি দল বেনাপোলের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান। খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের নেতৃত্বে নানা জনপ্রতিনিধি ও পারে বনগাঁর কাঁচাগোল্লা সন্দেশ, ফল-ফুল নিয়ে যান। “আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো” গানে তখনই মুখর হয়ে ওঠে ও পারের মঞ্চ। তাঁরা এ পারে ফিরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসমত আরা সাদেকের নেতৃত্বে জনাচল্লিশ বাংলাদেশী কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী আসেন এ পারে। তাঁরা কয়েক হাঁড়ি রসগোল্লা উপহার দেন। উত্তরীয় দিয়ে তাঁদের বরণ করার পর গানে মাতিয়ে দেন লোপামুদ্রা।

ঢাকায় যখন দুই দেশের দুই নেত্রীর আলোচনা চলছে জলবণ্টন নিয়ে, সীমান্তে তখন ভাষাবন্ধনে আবেগে ফের ভাসল দুই দেশ। হাজার হুমকি পেরিয়ে এ পার বাংলা, ও পার বাংলা ফের মিলিয়ে দিল একুশে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE