Advertisement
E-Paper

টাকা নিয়ে ভর্তির তদন্তে কথা নয় অভিযুক্ত ছাত্রনেতার সঙ্গেই

নদিয়ার ভক্তবালা বিএড কলেজে টাকা নিয়ে ভর্তি করানোর অভিযোগ মূলত যাঁর বিরুদ্ধে, তদন্তে গিয়ে তাঁর সঙ্গেই কথা বললেন না যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অভিজিত্‌ চক্রবর্তী। তাঁর বক্তব্য, এটা তাঁর তদন্তের শর্তের মধ্যে পড়ে না।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৪ ০৩:৪৫

নদিয়ার ভক্তবালা বিএড কলেজে টাকা নিয়ে ভর্তি করানোর অভিযোগ মূলত যাঁর বিরুদ্ধে, তদন্তে গিয়ে তাঁর সঙ্গেই কথা বললেন না যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অভিজিত্‌ চক্রবর্তী। তাঁর বক্তব্য, এটা তাঁর তদন্তের শর্তের মধ্যে পড়ে না। শুধু তা-ই নয়, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার যে গুরুতর অভিযোগ পেয়ে মঙ্গলবার এই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী, সেই বিষয়টিই ঠাঁই পায়নি তদন্তের বিষয় হিসেবে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্তে গিয়ে বুধবার এমনটাই জানিয়েছেন অভিজিত্‌বাবু। তদন্তটা তবে হচ্ছে কীসের, এটা নিয়েই তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।

অভিযোগ উঠেছে, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মী, সেখানকার টিএমসিপি ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক তন্ময় আচার্য ও ভক্তবালা বিএড কলেজ কর্তৃপক্ষ এক-এক জনের কাছ থেকে লাখ-দেড় লাখের বেশি টাকা নিয়ে বাড়তি ৩৯ জনকে ভর্তি করেছেন নদিয়ার ওই কলেজে। যার জেরে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন ওই ৩৯ জন পড়ুয়া। কিন্তু তদন্তের ভারপ্রাপ্ত অভিজিত্‌বাবুর বক্তব্য, তাঁকে যে শর্তাবলি দেওয়া হয়েছে তাতে অভিযুক্ত ছাত্রনেতা তন্ময় আচার্যের সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি নেই।

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁকেই জিজ্ঞাসাবাদ না করলে কি তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবে? অভিজিত্‌বাবুর ব্যাখ্যা, সংশ্লিষ্ট কলেজের পরিচালন সমিতির কর্তাদের সঙ্গে কথা বললেই দোষীদের চিহ্নিত করা যাবে, এই যুক্তিতেই অভিযুক্ত নেতার ব্যাপারটা বাদ রাখা হয়েছে শর্তাবলি থেকে।

শুধু তাই নয়, রাজ্য টিএমসিপি সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে অভিযোগ করেছেন, বাম-ঘনিষ্ঠ উপাচার্য ও পরীক্ষা নিয়ামক রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন। গুরুতর ওই অভিযোগ খতিয়ে দেখাও তাঁর তদন্তের বিষয় নয় বলে জানিয়েছেন অভিজিত্‌বাবু। অথচ শঙ্কুদেবের ওই অভিযোগের পরেই পার্থবাবু তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় যথেষ্ট ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল শিক্ষক মহলে। শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, পার্থবাবুর কাজে বিরক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং শিক্ষকদের একাংশ ঘনিষ্ঠমহলে পদত্যাগেরও ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তার পরেই তদন্তের শর্তাবলি থেকে বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়।

অভিজিত্‌বাবু তবে কী নিয়ে তদন্ত করছেন? উচ্চ শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, মূলত ৩টি বিষয় তদন্ত করে দেখতে বলা হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যকে।

এক, ছাত্র ভর্তিতে অনিয়ম হয়েছে কি না। যদি হয়ে থাকে সেটা কী?

দুই, এমন সমস্যা যাতে ভবিষ্যতে না হয়, তার জন্য পরামর্শ দেওয়া।

তিন, তদন্তের সূত্রে যদি অন্য কোনও তথ্য উঠে আসে, সেটা শিক্ষা দফতরকে জানানো।

অভিজিত্‌বাবু রাজ্যের শাসক দলের অতি ঘনিষ্ঠ। তাই তিনি নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারবেন কি না তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের একাংশে। অভিজিত্‌বাবু অবশ্য এমন আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, “আমি এক জন পেশাদার মানুষ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করছি না, এমন অভিযোগ আছে কি?” সেই সঙ্গে তাঁর যুক্তি, “এ ক্ষেত্রে তো সরকারের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ওঠেনি। তা হলে এমন প্রশ্ন উঠছেই বা কেন?”

তদন্তের স্বার্থে যদি অভিযুক্ত ছাত্রনেতার সঙ্গে কথা বলতে হয়, সে ক্ষেত্রে কী করবেন? অভিজিত্‌বাবুর জবাব, “আমার কাজ তো এখনও শেষ হয়নি! ফের আসতে হবে।” আগামী ৩ জুলাই ফের তিনি তদন্তের কাজে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন। পরবর্তী পর্যায়ে অভিযোগকারীদের সঙ্গে কথা বলতে তিনি ভক্তবালা কলেজেও যাবেন।

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রাথমিক তদন্ত শেষে অভিজিত্‌বাবু এ দিন বলেন, “উপাচার্য, রেজিস্ট্রার-সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। কলেজে ভর্তি, বিএড পাঠ্যক্রমে ভর্তি সংক্রান্ত নিয়মাবলি জেনেছি। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করছি।” পড়ুয়ারা যাঁদের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে অবৈধ ভাবে ভর্তির অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অভিযুক্ত শিক্ষক, কর্মী বা ছাত্রনেতারা সেই বৈঠকে ছিলেন না।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন ১০টা ৪০ মিনিটে বৈঠক শুরু হয়। রতনলালবাবু ছাড়াও ওই বৈঠকে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক বিমলেন্দু বিশ্বাস, কলেজ পরিদর্শক সুব্রত রায়, ভারপ্রাপ্ত নিবন্ধক প্রসেনজিত্‌ দেব, কলা বিভাগের ডিন সুমিত মুখোপাধ্যায় ও লাইব্রেরি সায়েন্সের অধ্যাপক জুরানকৃষ্ণ সরখেল। এঁদের বিরুদ্ধেই শঙ্কুদেব শিক্ষামন্ত্রীর কাছে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ এনেছেন।

দু’ঘণ্টার ওই বৈঠকে ভক্তবালা কলেজে অবৈধ ভাবে ভর্তি হওয়া ৩৯ জন পড়ুয়ার নথিপত্র অভিজিত্‌বাবুকে দেখানো হয়। তাঁদের মধ্যে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন, তাঁদের চিঠির প্রতিলিপি দেওয়া হয়। অভিযোগকারী ২১ জন পড়ুয়ার বক্তব্য ভিডিও করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তার সিডি-ও পেয়েছেন অভিজিত্‌বাবু।

এ দিকে প্রতারিত এক ছাত্রের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেছেন নদিয়া টিএমসিপি-র সভাপতি অয়ন দত্ত। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সাহেব শেখ এসএফআই করতেন। উনিই আমাদের সংগঠনকে হেয় করতে টিএমসিপি নেতা তন্ময় আচার্যের নামে অপবাদ দিচ্ছেন।’’ সাহেবের দাবি, ‘‘আমার সঙ্গে এসএফআই বা টিএমসিপি-র তন্ময়ের কোনও যোগ নেই। তৃণমূলের কোনও নেতাকে টাকাও দিইনি। টাকা দিয়েছি কলেজের মালিক অমরচন্দ্র বিশ্বাসকে। উপাচার্যকে চিঠি দিয়ে তা জানিয়েছি।” এসএফআইয়ের জেলা সম্পাদক জাহাঙ্গির আলির অভিযোগ, “নিজেদের মুখ বাঁচাতে টিএমসিপি এক জন ভুক্তভোগীকে ফাঁসাচ্ছে,’’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রতনলাল হাংলু এ দিন ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, দুর্নীতির অভিযোগকে যে ভাবে রাজনীতির উঠোনে টেনে আনা হচ্ছে ও বিকৃত ভাবে প্রচার করা হচ্ছে তা অনভিপ্রেত। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারকে অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে।

তিনি নিজে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও টিএমসিপি-র চাপে রাজ্য সরকারের এই তদন্ত কি অসম্মানজনক নয়? উপাচার্য বলেন, “রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার বলার কী থাকতে পারে?” তবে তাঁর মন্তব্য, “প্রশ্নটা যখন দুর্নীতির, তখন কে কোন রাজনীতি করেন, তা ভাবার কোনও জায়গাই নেই। শিক্ষার ক্ষেত্রে যদি দুর্নীতি রোধ না করা যায়, তা হলে ভবিষ্যত্‌ প্রজন্মকে আমরা কোন শিক্ষা দেব?” উপাচার্য দাবি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ দুর্নীতিতে জড়িত থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে আছে। রতনলালবাবু বুধবার রাতেই আমেরিকায় যাচ্ছেন দিন দশেকের ছুটি কাটাতে। ফলে তাঁর সঙ্গে কথা সেরে রেখেছেন অভিজিত্‌বাবু।

ভর্তি-দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত শুরু হলেও রেজিস্ট্রেশন না পাওয়া নদিয়া, হুগলি, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের ওই ৩৯ জন পড়ুয়ার ভবিষ্যত্‌ কী হবে? বিশ্ববিদ্যালয় মঙ্গলবার জানিয়েছে, তাঁদেরও পরীক্ষা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। বুধবার শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, “সব ছাত্রছাত্রী যাতে পরীক্ষা দিতে পারেন, সে জন্য সব রকম সহযোগিতা করবে রাজ্য সরকার।” কিন্তু এতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না ওই ছাত্রছাত্রীরা। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, ৩টি শর্ত মেনে মুচলেকা দিলে তবেই অ্যাডমিট কার্ড মিলবে। এক, তদন্ত-কমিটির রিপোর্ট বেরনোর আগে ফল জানানো হবে না। দুই, ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন (এনসিটিই)-র নিয়ম অনুযায়ী কোনও কলেজে বিএডে ১০০-র বেশি ছাত্র নেওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে বাড়তি পড়ুয়ার ব্যাপারে এনসিটিই-র মতের উপরেই নির্ভর করবে এই ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যত্‌। তিন, এই ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ভবিষ্যতে আইনি জটিলতা হলে তার দায় বিশ্ববিদ্যালয় নেবে না। এমন মুচলেকা দিলে তবেই ৭ জুলাই থেকে পরীক্ষায় বসতে পারবেন পড়ুয়ারা। যদিও এত টানাপোড়েনের পর পরীক্ষায় বসতে পারলেও এই ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যত্‌ পুরোপরি অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে। আইনি জটে পড়লে আশা নেই বিশ্ববিদ্যালয়কে পাশে পাওয়ারও।

bhaktabala bed college controversy avijit chakraborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy