বিস্ফোরণ হয়েছে ২ অক্টোবর। তার মোবাইল খোলা ছিল ৯ অক্টোবর পর্যন্ত। টাওয়ার জানাচ্ছিল, সেই মোবাইল এখন মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায়। কিন্তু এই সাত দিনে কারও ফুরসত হয়নি, সেই সূত্র ধরে বিস্ফোরণ কাণ্ডের পাণ্ডাকে খুঁজে দেখার। শুক্রবার থেকে সেই মোবাইলে আর কোনও সাড়া নেই। বেলডাঙায় খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল, পাখি হাওয়া! হাতের নাগালে পেয়েও স্রেফ ঢিলেমি করাতেই খাগড়াগড় বিস্ফোরণের মূল চাঁই ইউসুফ শেখ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছে বলে অনুমান গোয়েন্দাকর্তাদের একাংশের। বেলডাঙায় থাকাকালীন খাগড়াগড়-কাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত আরও কয়েক জনের সঙ্গে সে ঘোরাঘুরি করেছে এবং সেই সঙ্গীদের নিয়েই লালবাগ হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছে বলে সন্দেহ সিআইডি-র তদন্তকারীদের।
কেন সাত দিন সময় পেয়েও সিআইডি তাকে ধরতে পারল না, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। ইচ্ছে করেই ইউসুফকে পালাতে দেওয়া হল কি না, উঠেছে সেই প্রশ্নও। নিজেদের সূত্র মারফত বিষয়টি কানে গিয়েছে বর্ধমানের ঘটনা নিয়ে তদন্তে নামা এনআইএ-রও। খাগড়াগড়-কাণ্ডের কুশীলবদের যে তালিকা এনআইএ তৈরি করেছে, তার উপরের দিকেই রয়েছে এই ইউসুফের নাম। তার উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে বলে এনআইএ সূত্রের খবর।
কে এই ইউসুফ শেখ?
মঙ্গলকোটের যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক ছিল ইউসুফ,
সেখানে এখন পুলিশি প্রহরা। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়
খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের পরে পুলিশের ধারণা হয়, নিহত শাকিলই এই কার্যকলাপের পাণ্ডা। কিন্তু ধৃত রাজিয়া ও আলিমা বিবিকে জেরা করে এই ঘটনার সঙ্গে আরও অনেকের জড়িত থাকার কথা জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। সেই সূত্রেই উঠে এসেছে ইউসুফ শেখের নাম। সিআইডি-র তদন্তকারীরা মনে করছেন, সে-ই বিস্ফোরণ কাণ্ডের পাণ্ডা।
কী ভাবে?
গোয়েন্দারা তদন্তে জানতে পেরেছেন, মঙ্গলকোটের একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক ছিল ইউসুফ। মূলত মহিলাদেরই প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো সেখানে। বাংলাদেশের হাতকাটা নাসিরুল্লার সঙ্গে যৌথ ভাবে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করত ইউসুফ। দু’জনেই জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-র নেতা এবং ওই প্রতিষ্ঠানটি জামাতের অর্থেই গড়ে উঠেছিল বলেও জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। খাগড়াগড় কাণ্ডের তদন্তে নেমে পুলিশ যাদের নাম জানতে পেরেছে, সেই কওসর, হাতকাটা নাসিরুল্লা, সাজিদ, সাকিবও বিস্ফোরণের পরে বেলডাঙায় ইউসুফের সঙ্গে ছিল বলে তদন্তকারীদের ধারণা। ইউসুফের সঙ্গেই এরাও বাংলাদেশে পালিয়েছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।
সূত্রের খবর, নিহত শাকিল বোমা বানিয়ে বাংলাদেশে পাঠাত। সেটা ছিল জামাতের কর্মসূচির একটি অঙ্গ। ইউসুফ আবার যুক্ত ছিল অন্য একটি কাজের সঙ্গে। হাতকাটা নাসিরুল্লার সঙ্গে মিলে সে ধর্ম ও অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে বাংলাদেশের হিজবুল মুজাহিদিনের জন্য বাহিনী তৈরি করত। বর্ধমান-কাণ্ডে ধৃত রাজিয়া ও আলিমাকে এই দু’জনই ধর্ম ও অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছিল বলে জানাচ্ছেন সূত্রটি।
বছর তিরিশের ইউসুফের বাড়ি মঙ্গলকোটের কৃষ্ণবাটি গ্রামে। সে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে বলে প্রতিবেশীদের খবর। স্কুলের পাঠ শেষ করে গ্রামেই চাষ-আবাদ করত সে। ২০০৪ সাল নাগাদ মঙ্গলকোটের ন’পাড়ার বাসিন্দা আয়েষা বিবির সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পুলিশ সূত্রের খবর, ২০০৭ সাল নাগাদ ইউসুফ উত্তরপ্রদেশে চলে যায়। ২০০৯ সাল নাগাদ গ্রামে ফিরে সে প্রচার করে, উত্তরপ্রদেশে একটি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছে সে। সেখান থেকে পাওয়া শিক্ষা অনুযায়ী সে গ্রামে নারী শিক্ষার জন্য কিছু করতে চায় বলে প্রচার করে সেই কাজের জন্য জমি চেয়ে গ্রামবাসীদের কাছে আবেদনও করে ইউসুফ।
পুলিশ সূত্রের খবর, পাশের শিমুলিয়া গ্রামের এক বাসিন্দা ৪ কাঠা জমি দেন ইউসুফকে। সেখানেই গড়ে ওঠে ওই প্রতিষ্ঠানটি। সেটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ইউসুফ-ই। সেখানে কী ধরনের শিক্ষা দেওয়া হতো, এখন তা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ইউসুফের স্ত্রী আয়েষাও ওই প্রতিষ্ঠানে পড়াত। পুলিশ ও পরিবারের একটি সূত্রের দাবি, গত ৬ অক্টোবর ইউসুফ ও আয়েষা বাড়ি থেকে ‘বেরোচ্ছি’ বলে বেরিয়ে যায়। তার পর থেকে তাদের আর কোনও খোঁজ পাননি পরিবারের লোকেরা। তাদের ২ মেয়ে ও এক ছেলেকে ন’পাড়ায় মামার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
ইউসুফের বাবা আব্দুল হাফিজ শনিবার বলেন, “কোথাও ভুল হচ্ছে। ঘটনার সঠিক তদন্ত দরকার। আমার ছেলে এলাকায় নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য কাজ করত।” ইউসুফের মায়ের নাম মহসিনা বিবি। ইউসুফের এক ভাই বানী ইসরাইল শেখ বর্তমানে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা করেছেন। আরও এক ভাই বজরুল শেখ বর্তমানে কেরলে আছেন। ইউসুফের প্রতিষ্ঠানটি পুলিশি ঘেরাটপে রয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, বিস্ফোরণের পর থেকেই ইউসুফ-সহ এই ঘটনায় জড়িত অন্যদের মোবাইল সুইচ্ড অফ ছিল। ইউসুফের ফোনটি অবশ্য কখনও কখনও খোলা হয়েছে বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। কিন্তু গত ৯ অক্টোবর ইউসুফের মোবাইল সারা দিনই খোলা ছিল বলে জানতে পেরেছে পুলিশ। টাওয়ার লোকেশনের সূত্র ধরেই পুলিশ জানতে পারে, সে বেলডাঙাতেই ছিল ওই দিন। কিন্তু পর দিন সকাল থেকেই ফোনটি ফের সুইচ্ড অফ হয়ে যায়। তদন্তকারীরাও আর ইউসুফের নাগাল পাননি।