Advertisement
০৩ মে ২০২৪

ত্রিফলা, যোগব্যায়ামের অনুশাসনে তারকা মানিক

কর্ডলেস হ্যান্ডসেটের ব্যাটারিটা গোলমাল করছে। কথার মাঝখানে ঝুপ করে সব নিঃশব্দ! প্রবাসে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম তো ওই ল্যান্ডলাইন। বারবার কেটে গেলে ভাল লাগে? অ্যাডিশনাল রেসিডেন্ট কমিশনার অগত্যা নিজের দফতরের কর্ডলেসটা মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে দিয়ে গিয়েছেন। আপাতত কাজ চলুক। সঙ্গে নিজের অফিসে কড়া নির্দেশ, রাতে স্যার ফিরে আসার আগে যেন চার্জ-টার্জ দিয়ে ব্যাটারি স্বমহিমায় ফিরে যায়!

বর্ধমানে সিপিএমের জেলা অফিসে মানিক সরকার।  ছবি: উদিত সিংহ।

বর্ধমানে সিপিএমের জেলা অফিসে মানিক সরকার। ছবি: উদিত সিংহ।

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৫৬
Share: Save:

কর্ডলেস হ্যান্ডসেটের ব্যাটারিটা গোলমাল করছে। কথার মাঝখানে ঝুপ করে সব নিঃশব্দ! প্রবাসে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম তো ওই ল্যান্ডলাইন। বারবার কেটে গেলে ভাল লাগে?

অ্যাডিশনাল রেসিডেন্ট কমিশনার অগত্যা নিজের দফতরের কর্ডলেসটা মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে দিয়ে গিয়েছেন। আপাতত কাজ চলুক। সঙ্গে নিজের অফিসে কড়া নির্দেশ, রাতে স্যার ফিরে আসার আগে যেন চার্জ-টার্জ দিয়ে ব্যাটারি স্বমহিমায় ফিরে যায়!

স্মার্ট ফোন, হোয়াটস্ অ্যাপের গ্রহে এখনও তিনি ল্যান্ডই করেননি! মোবাইলে অধরা। কিন্তু নিজে ভয়ঙ্কর মোবাইল! একটা বড় সফ্ট স্যুটকেস আর একটা ব্যাগ সাকুল্যে এই লোটা-কম্বল নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মোবাইলের চার্জ? সকালে উঠে ঝাড়া দেড় ঘণ্টার যোগব্যায়াম।

ইনি মানিক সরকার। দেশের একমাত্র বাম-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য। এবং দলের ‘স্টার ক্যাম্পেনার’। তবে তারকা শুধু নির্বাচন কমিশনে দাখিল-করা তালিকায়। তারকার কোনও অনুষঙ্গই এই মানিকের গায়ে লাগানোর উপায় নেই! কলকাতায় ত্রিপুরা ভবনের ১১০ নম্বর ঘরের অতিথি ‘এই ঠিক আছি’ মার্কা হাসি নিয়ে দলের দেওয়া দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

নিজের রাজ্য ত্রিপুরার দু’টি আসনে দুই পর্বে ভোট হয়ে গিয়েছে। জনাদেশ বাক্সবন্দি থাকবে এক মাসেরও বেশি। মাঝের সময়টা আগরতলায় স্ত্রীকে রেখে বেরিয়ে পড়েছেন মানিক। সঙ্গে নিজের রাজ্যের দুই নিরাপত্তারক্ষী। আগরতলা থেকে কলকাতা। এক রাত্তির কাটিয়ে চেন্নাইয়ের উড়ান। তামিলনাড়ুর নানা কেন্দ্রে প্রচার সেরে গুয়াহাটির ত্রিপুরা ভবন। সেখান থেকে আবার কলকাতা। মুর্শিদাবাদ, হুগলি, হাওড়া, বর্ধমানে সমাবেশের আমন্ত্রণরক্ষা। এই দফায় টানা ১২ দিন বাইরে কাটিয়ে আজ, বৃহস্পতিবার ফিরছেন স্বগৃহে। মাত্রই দু’দিনের

জন্য। রবিবার আবার স্যুটকেস হাতে বিমানবন্দরে!

এত মুখ্যমন্ত্রী প্রচারে বেরিয়েছেন। সবাই প্রায় হেলিকপ্টারে। তাঁকে তো আকাশ-পথে ভোট-পাখি হতে দেখা যাচ্ছে না? “আমাদের কি অত পয়সা আছে?” স্মিত হাসছেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী। বাজেটে পিছিয়ে। কিন্তু মূল্যবোধে টানটান! মুখ্যমন্ত্রী হলেও ভোটের সময় তাঁর থাকা-খাওয়ার খরচা দলকেই নিতে হবে। সফর মিটে গেলে এক বারে বিল মিটিয়ে দেওয়াই রেওয়াজ। কিন্তু মানিক সে বান্দা নন! তাঁর ঘরে এক কাপ চা নিয়ে যিনি আসছেন, তাঁরও হাতে হাতে বিল চুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিলও আপডেট হয়ে যাচ্ছে ফি রোজ! যদি কোথাও আটকে গিয়ে ফেরা না হয়!

কী এনেছেন সঙ্গে? “ওই তো পাঁচ সেট পাজামা-পাঞ্জাবি। আর লুঙ্গি, গেঞ্জি, চটি এই সব। বেশি আর কী লাগে?” হেসেই জবাব দিচ্ছেন মানিক। সঙ্গে আরও বলছেন, “যেখানে কয়েকটা দিন থাকছি, ওগুলো ধুয়ে-কেচে নিচ্ছি। কোনও ঝামেলা নেই!” ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর সাদা ভাবমূর্তিতে এমনিতে কাদা নেই। সফররত মানিকের পাজামা-পাঞ্জাবিও তা-ই! ধবধবে! রানিগঞ্জ যাবেন বলে বুধবার ত্রিপুরা ভবনের ঘর থেকে নীচে নামলেন যখন, তখনও মালুম হল। দীর্ঘ পথ বলে সকাল-সকাল রওনা দিচ্ছেন। মাঝে বর্ধমানে পার্টি অফিসে খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার বাকি পথ।

কী খাচ্ছেন? ত্রিপুরায় যা করেন, অন্যত্রও তা-ই। সকালে শরীরচর্চার ফাঁকে ত্রিফলার জল মাস্ট। সাধারণত টোস্ট দিয়ে প্রাতরাশ। দুপুরে ভাতের সঙ্গে মাছ, হাল্কা ঝোল পছন্দ। রাতে কখনও ভাত, কখনও রুটি। পায়ে একটা অসুবিধা হচ্ছিল বলে এসএসকেএম থেকে ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছেন এক বার। তামিলনাড়ুতে হোটেলে ছিলেন। খাবারদাবার যেমন পাওয়া গিয়েছে, চালিয়ে নিয়েছেন।

সাধারণত লম্বা বক্তৃতায় অভ্যস্ত। এত বক্তৃতা করছেন, আর পাঁচ জন রাজনীতিকের মতো গলা তো কই ভাঙেনি? বাম মুখ্যমন্ত্রীর এক সহকর্মীর কথায়, “উনি তো চেঁচান না! উত্তেজিতও হন না! সব সময় একই রকম স্বাভাবিক।” এ বার বাংলায় ভোট-বাজারে সব কি স্বাভাবিক দেখছেন? মানিক বলছেন, “মিটিং তো বেশ ভালই হচ্ছে। যে ক’টা জায়গায় গেলাম, লোকজনের সঙ্গে কথা হল। তবে হাওড়ায় সন্ত্রাসের একটা সমস্যা আছে মনে হচ্ছে।” বামেদের ঝুলি ভরবে? “পরিবেশ দেখছি, লোকজনের সঙ্গে কথা হচ্ছে। আমাদের ভালই হবে মনে হচ্ছে। তবে বাক্স না খুললে সবটা বোঝা যায় না!”

রাজ্যের বাইরে বসে টিভি খুললে, পত্র-পত্রিকার পাতা ওল্টালে শুধুই নরেন্দ্র মোদীর মুখ! মানিকের অভিজ্ঞতা বলছে, “সব জায়গাতেই বিজেপি নিশ্চয়ই কিছু ভোট পাবে। কিন্তু আমি তো এত হাওয়া কিছু দেখছি না! তামিলনাড়ুতে মোদী-মোদী কিছু নেই। অসমে ওদের চারটে আসন বাঁচিয়ে দু-একটা বাড়তি পেতে পারে। উত্তরপ্রদেশ যাইনি। কিন্তু খবর-টবর পড়ে মনে হচ্ছে, মাসদেড়েক আগেও যা ছিল, এখন তেমন হাওয়া নেই।”

হতেও পারে। আপাতত সারদা-হাওয়ায় বাম তরী তরিয়ে দিতে বঙ্গের জেলায় জেলায় বেরিয়ে পড়েছেন মানিক। চেনা আসন বদলে ভাড়া-নেওয়া এসইউভি-র সামনের সিটে আসীন। আসলে তিনিও কর্ডলেস! পার্টির ‘বেস’ ছুঁয়ে নিজের পরিধিটা ক্রমে বাড়িয়ে চলেছেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

loksabha election manik sarkar cpm
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE