Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

তোলাচিত্র বদলায়নি স্টেশন চত্বরে

হাওড়া পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ড। স্টেশনঘেঁষা এই ঘিঞ্জি এলাকাই শহরে তোলাবাজির অন্যতম আঁতুড়ঘর বলে জানে সাধারণ মানুষ। মূলত ব্যবসার কারণে রাতভর জেগে থাকে ওই চত্বর। লজ থেকে হোটেল, মাছের পাইকারি বাজার, দূরপাল্লার বাসস্ট্যান্ড ঘিরে সন্ধে নামলেই আনাচে-কানাচে জমে ওঠে জুয়া, সাট্টা ও চোলাই মদের ঠেক। কাঁচা টাকা ওড়ে সেখানে। মাঝেমধ্যে মধুচক্র কিংবা বেটিং চক্রে জড়িয়ে পড়ে কিছু হোটেলের নাম। অসামাজিক কাজকর্মকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ওঠে একাধিক লজের বিরুদ্ধে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৪ ০৩:৪১
Share: Save:

হাওড়া পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ড। স্টেশনঘেঁষা এই ঘিঞ্জি এলাকাই শহরে তোলাবাজির অন্যতম আঁতুড়ঘর বলে জানে সাধারণ মানুষ।

মূলত ব্যবসার কারণে রাতভর জেগে থাকে ওই চত্বর। লজ থেকে হোটেল, মাছের পাইকারি বাজার, দূরপাল্লার বাসস্ট্যান্ড ঘিরে সন্ধে নামলেই আনাচে-কানাচে জমে ওঠে জুয়া, সাট্টা ও চোলাই মদের ঠেক। কাঁচা টাকা ওড়ে সেখানে। মাঝেমধ্যে মধুচক্র কিংবা বেটিং চক্রে জড়িয়ে পড়ে কিছু হোটেলের নাম। অসামাজিক কাজকর্মকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ওঠে একাধিক লজের বিরুদ্ধে। আইন এড়িয়ে সে সব অপরাধ সালটে দেওয়ার জন্য মোটা টাকা দিতে হয় দাদাদের, হররোজ, হামেশাই। এবং সেই কারণেই ওই ব্যবসায়ী-এলাকার দখল নিজের হাতে রাখতে চায় শাসক দল। তিন বছর আগে রাজ্যে ক্ষমতা বদল হলেও আগের ট্র্যাডিশনের কোনও বদল ঘটেনি। জার্সি বদল করে সেই পুরনো মুখগুলোই এখন নিয়ন্ত্রক হাওড়া স্টেশন এলাকার।

সেই সূত্রেই উঠে আসে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের নাম। বাম আমলে ওই এলাকার রাশ ছিল সিপিএমের হাতে। ওই ১৪ নম্বর ওয়ার্ডেরই কাউন্সিলর মীনা সিংহের স্বামী স্থানীয় বিধায়ক লগনদেও সিংহের শাসনে চলত গোটা স্টেশন এলাকা। এখন অবশ্য সে কথা মানতে চান না লগনদেও। বলেন, “এ সব তৃণমূলের অপপ্রচার।”

লগনদেও মানুন আর না-ই মানুন, অভিযোগ, তাঁর দেখানো পথেই চলছে হাওড়ার তৃণমূল। ক’দিন আগে স্টেশন লাগোয়া একটি হোটেলে তোলা আদায়ে বাধা পেয়ে ম্যানেজারকে মারধর ও ফোনে হুমকি পেয়ে মালিকের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িয়েছে সেই ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের নামই। এ বার অভিযোগের তির স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর লক্ষ্মী সাহানির স্বামী সন্তোষ সাহানির বিরুদ্ধে। তিনি আবার ওই ওয়ার্ডে তৃণমূলের সভাপতিও বটে। তবে সন্তোষের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এই প্রথম নয়। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর দাবি মতো তোলা দিতে না পারায় বেধড়ক মার খেতে হয়েছিল গ্রাম থেকে আসা সবজি বিক্রেতাদের। পুলিশ জানাচ্ছে, ওই ঘটনায় সন্তোষের নামে গোলাবাড়ি থানায় তোলাবাজির অভিযোগ দায়ের হয়েছিল।

ব্যাস, ওই পর্যন্তই। এর পরে তদন্ত আর ছিঁটেফোঁটা এগোয়নি। কেন? হাওড়া তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, উত্তর হাওড়ার তৃণমূল সভাপতি তথা পুরসভার মেয়র পারিষদ গৌতম চৌধুরীর খুব কাছের লোক এক কালের রিকশাচালক এই সন্তোষ। গৌতমবাবু আবার রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী তথা শহর তৃণমূলের সভাপতি অরূপ রায়ের ঘনিষ্ঠ। সেই কারণে সন্তোষ ও তাঁর দলবলের নামে পুলিশে অভিযোগ জমা পড়লেও তদন্ত হয় না। দিব্যি ঘুরে বেড়ান অভিযুক্তেরা।

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

এই অভিযোগ অবশ্য মানতে চাননি তৃণমূলের দুই নেতাই। অরূপবাবু বলেন, “আমি এ সব বিষয়ে কোনও দিনই থাকিনি। আমি-ই তো পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছি, তৃণমূলের কেউ তোলাবাজি করলে তাকে নির্দিষ্ট মামলা দিয়ে গ্রেফতার করতে হবে।” আর গৌতমবাবুর বক্তব্য, “অভিযোগ করলেই শুধু হবে না, প্রমাণ করতে হবে। যে দু’জনের নাম তোলাবাজিতে উঠছে, অনেক আগেই তাদের আমরা দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি।”

হাওড়া স্টেশন এলাকা থেকে রাজনৈতিক দলগুলির তোলাবাজি অবশ্য নতুন নয়। বাম আমলে সিটুর ছত্রছায়ায় থাকা ট্যাক্সিচালক, হকার, দোকানি, হোটেল মালিক সকলকেই চাঁদা (পড়ুন তোলা) দিতে হত বলে অভিযোগ। সেই তোলার বখরা নিয়ে গোলমাল কখনও প্রকাশ্যে চলে এলে রাশ টেনে ধরত সংগঠন। এখনকার তোলাবাজেরা নিয়ন্ত্রণহীন। অভিযোগ, রাজ্যে রাজনৈতিক পালা বদলের পর থেকে হাওড়া স্টেশন এলাকায় জুলুম উত্তরোত্তর বেড়েছে। হাওড়া পুরসভায় তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে ওই চত্বর শাসকদলের একাংশের কামধেনু।

কোথা থেকে হয় তোলাবাজি? স্টেশন চত্বরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা একাধিক ব্যবসায়ী জানান, মূলত যেখানে অর্থের দৈনন্দিন আদান-প্রদান হয় সেখানেই তোলাবাজদের নজর। যেমন স্টেশন চত্বরে গজিয়ে ওঠা খাবার দোকান, হোটেল, লজ, বাস, ট্যাক্সি, হকার, মাছ-পান-সবজির বাজার ও বেআইনি পার্কিং। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার কিছু দিনের মধ্যেই সন্তোষের দলবল ওই এলাকার দখল নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। তার পরেই শুরু হয় মাছ, পান ও সবজির বাজার থেকে ভয় দেখিয়ে তোলা আদায়। পুলিশ জানাচ্ছে, মূলত দীপক সাউ ও রিয়াজ আহমেদ-ই তোলাবাজির নেতৃত্ব দিত। সন্তোষ তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতেন বলে অভিযোগ। এর মধ্যেই গত ডিসেম্বরে সন্তোষের স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী পুর-ভোটে জিতে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হন। পুলিশ জানাচ্ছে, এর পরেই সন্তোষ কার্যত হাওড়া স্টেশন এলাকার অলিখিত ‘ডন’ হয়ে ওঠেন।

সন্তোষ সাহানি অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন, বলেছেন, “এ সব বিরোধীদের বানানো গল্প। একটা শক্তি আমাকে এখান থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। এটা তাদেরই চক্রান্ত।”

স্টেশনের একাধিক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, স্টেশন চত্বরে কোন হকার কোথায় ডালা নিয়ে বসবে, তার জন্য কত দিতে হবে, মদের ঠেক চালানোর নজরানা কত, ফুটপাত দখল করে খাবার স্টল দিতেই বা কত দক্ষিণা পড়বে সব ক্ষেত্রে সন্তোষের কথাই শেষ কথা। দোকানদারদের একাংশের অভিযোগ, হাওড়া স্টেশনে প্রি-পেড ট্যাক্সি স্ট্যান্ড গড়ে উঠলেও বাস স্ট্যান্ডের দিকে গড়ে উঠেছে বেআইনি ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। দালালেরা বলেন ‘ফাইল ট্যাক্সি’-র স্ট্যান্ড। অভিযোগ, সেখান থেকে যাত্রী তুলতে প্রতিটি ট্যাক্সিকে তৃণমূল বাহিনীকে দিনে ২০ টাকা দিতে হয়। বাস স্ট্যান্ড চত্বরে হকারদের ‘ডালা’ পাতলে দিতে হয় ৩০০ টাকা। এ ছাড়াও স্টেশন চত্বরে গড়ে ওঠা বড়, মাঝারি বা ছোট হোটেলকে তোলা দিতে হয় প্রতি দিনই। আর যদি নানা রকম ফুর্তির আসর বসে, তা হলে তোলার পরিমাণ বেড়ে যায় এক লাফে অনেকটাই।

এলাকার প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক লগনদেও সিংহও তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। তাঁর বক্তব্য, “স্টেশন এলাকায় আমি বিধায়ক তহবিল থেকে চারটি শৌচাগার তৈরি করেছিলাম। সন্তোষ ও তার বাহিনী সেগুলি দখল করে রোজ কয়েক হাজার টাকা আয় করে। পুরসভাকে সেই টাকা জমা দেয় না।” লগনবাবুর আরও অভিযোগ, সন্তোষের নেতৃত্বেই হুগলি জলপথ সমবায় সমিতির টিকিট কাউন্টারের পাশে হোটেল গজিয়ে উঠেছে। সেখান থেকেও মোটা আয় হয় প্রতি দিন।

কিন্তু নালিশ পাল্টা নালিশই সার। রাজ্যে শাসক বদলেছে, কিন্তু হাওড়া স্টেশনের তোলাবাজির চিত্রটা বদলায়নি। বরং ভুক্তভোগীরা বলছেন, নতুন আমলে আরও নিয়ন্ত্রণহীন হয়েছে তোলাবাজেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE