Advertisement
০৬ মে ২০২৪

তোলার সাক্ষ্য দিতে তৈরি বহু তৃণমূল নেতাই

দলের এক নেতার বিরুদ্ধে তোলাবাজির প্রকাশ্য অভিযোগ তুলে শীর্ষ নেতৃত্বের রোষের মুখে পড়েছেন পূর্বস্থলীর তৃণমূল বিধায়ক। অথচ গোটা দিন কেটে গেলেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরিস্থিতি দেখে এ বার বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়ে তোলাবাজি নিয়ে সরব হলেন বর্ধমানের আরও কিছু তৃণমূল নেতা।

তপন চট্টোপাধ্যায়।—ফাইল চিত্র।

তপন চট্টোপাধ্যায়।—ফাইল চিত্র।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য
পূর্বস্থলী শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:০৭
Share: Save:

দলের এক নেতার বিরুদ্ধে তোলাবাজির প্রকাশ্য অভিযোগ তুলে শীর্ষ নেতৃত্বের রোষের মুখে পড়েছেন পূর্বস্থলীর তৃণমূল বিধায়ক। অথচ গোটা দিন কেটে গেলেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

পরিস্থিতি দেখে এ বার বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়ে তোলাবাজি নিয়ে সরব হলেন বর্ধমানের আরও কিছু তৃণমূল নেতা। কী ভাবে তোলাবাজি চলছে, পূর্বস্থলীর বিভিন্ন স্তরের নেতারা তা মুখ্যমন্ত্রী-সহ শীর্ষনেতৃত্বকে চিঠি দিয়ে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ওই নেতাদের বক্তব্য, শীর্ষ নেতারা বারবার দলের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখার কথা বললেও আসলে অপরাধ ধামাচাপা দিতেই বেশি ব্যস্ত। তা না হলে, তাঁদের হাতে তোলাবাজির ‘প্রমাণ’ তুলে দেওয়া সত্ত্বেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন?

উল্টে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় যে ভাবে শৃঙ্খলাভঙ্গ এবং ‘হিরো সাজা’র অভিযোগ তুলে তপনবাবুকেই ফোন করে ধমকেছেন, তাতে তাঁরা বিস্মিত। এ রকম চলতে থাকলে তাঁরা ‘বিকল্প রাজনীতি’র কথা ভাবতে পারেন বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন কেউ-কেউ।

তপনবাবুর অভিযোগ ছিল, তৃণমূলের জেলা পরিষদ সদস্য বিপুল দাস রক্তদান শিবিরের নামে তৃণমূলের বিল দিয়ে তোলা তুলেছেন। গত ১১ অক্টোবর পূর্বস্থলীতে ওই রক্তদান শিবিরের আগেই তিনি কলকাতায় একাধিক নেতাকে ফোন করে বিষয়টি জানান। কিন্তু তাতে কেউ কর্ণপাত করেননি। এর পরে ১৯ অক্টোবর মন্তেশ্বরের কুসুমগ্রামে বিজয়া সম্মিলনীতে সরাসরি কারও নাম না করে তিনি ফের তোলাবাজির অভিযোগ তোলেন। ৩০ অক্টোবর কলকাতায় তৃণমূল ভবনে এসে সেই তোলাবাজির ‘প্রমাণ’ হিসেবে মুকুল রায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়দের কাছে ‘৫০০০ হাজার টাকা’ লেখা সাদা খাম দেখান। তৃণমূলের নামে ছাপানো বিলের নমুনাও দেন। দলের নির্দেশে বুধবার লিখিত ভাবেও সব জানিয়েছেন।

এর পরেও ব্যবস্থা নিতে দেরি হচ্ছে কেন?

পার্থবাবু বলেন, “তপনবাবুর চিঠি আমরা পেয়েছি। শুক্রবার দলীয় বৈঠকে আলোচনা করে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেব।” তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্ব সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই কলকাতা থেকে বিপুল দাসকে ফোন করে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন, যে রসিদ দিয়ে তিনি টাকা তুলেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে, তাতে তাঁর সই নেই। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন: তা হলে, কী ভাবে প্রমাণ হল যে তিনিই ওই বিল দিয়ে টাকা তুলেছেন? সেই কারণেই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে আরও বিশদে খোঁজ নিতে হচ্ছে। রাজের মন্ত্রী তথা দলের জেলা সম্পাদক (গ্রামীণ)

স্বপন দেবনাথও বলেন, “অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

তৃণমূলের অন্দরেই প্রশ্ন হল, নিছক সই না থাকাতেই কি তৃণমূল নেতৃত্ব নিশ্চিত হতে পারছেন না, দলের নামে বিল ছাপিয়ে কে তোলা তুলেছে? যেখানে সাংসদ, বিধায়ক, জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি সবই তৃণমূলের, সাংগঠনিক স্তর থেকে খবর নেওয়া হচ্ছে না কেন? তোলাবাজি করা হয়েছে কি না, হয়ে থাকলে তাতে কে বা কারা জড়িত তা জানতে অভিযুক্তের কথার উপরেই কেন নির্ভর করে বসে থাকতে হচ্ছে তৃণমূল ভবনকে?

জেলা তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, বিপুল দাস ও তাঁর অনুগামীরা কী ভাবে রক্তদান শিবির, রাখিবন্ধন-সহ নানা উৎসবের নাম করে টাকা তুলছেন এবং দুর্নীতি করছেন, তা মাস তিনেক আগেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছিল।

সেই চিঠিতে তৃণমূলের ৬৭ জন পঞ্চায়েত সদস্য, ১৪ জন পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য, ৫ জন পঞ্চায়েত প্রধান এবং ১৭৬ জন বুথ সভাপতির সই ছিল। ডাকযোগে সেই চিঠিটিই তাঁরা ফের তৃণমূল ভবনে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

পূর্বস্থলী ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি গোপা ঘোষ সরাসরি কারও নাম না করে বলেন, “গত ১৮ সেপ্টেম্বর ওই তোলাবাজদের এক জন আমার কার্যালয়ে এসে গালিগালাজ করে টাকা চায়। আমি তা দিতে রাজি না হলে পদ কেড়ে নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। ২১ সেপ্টেম্বর জেলা সভাপতি স্বপনবাবুকে চিঠি দিয়ে সব জানাই।” এর পরে দেড় মাস পেরিয়ে গিয়েছে। ক্ষুব্ধ গোপাদেবীর মন্তব্য, “দল এখনও পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।” কেন? স্বপনবাবু এই নিয়ে একটিও কথা বলতে চাননি।

গোটা বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি বিপুলবাবুও। তবে তপনবাবুর দাবি, “আমি কিন্তু শুধু-শুধু অভিযোগ করিনি। আমার কাছে এলাকার একাধিক স্কুলশিক্ষক, ঠিকাদার, কাঠ চেরাই কলের মালিক, ইটভাটা ইউনিয়নের সম্পাদক লিখিত ভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন। তার ভিত্তিতেই আমি দলকে জানিয়েছি।” কিন্তু তার পরেও তাঁকে যে ভাবে ধমকানো হয়েছে, সেটা বহু নেতা-কর্মীরই মনঃপুত হয়নি।

তৃণমূলের পূর্বস্থলী ২ ব্লক সভাপতি বদরুল আলম শেখ বলেন, “বিধায়ক তো আগেই রাজ্য নেতাদের সব জানিয়েছিলেন। পরে কর্মিসভায় তোলাবাজি নিয়ে মন্তব্য করেন। এতে দোষের কি আছে!” ব্লক সম্পাদক তাপস বাগচীও মনে করেন, ওই ব্লকে দলের ‘শুদ্ধকরণ’ প্রয়োজন। সেই উদ্দেশ্যে বিধায়ক যদি কিছু বলেও থাকেন, তা নিয়ে বিতর্ক হওয়া কাম্য নয়। পূর্বস্থলীর এক পঞ্চায়েত প্রধানের মতে, “তপনদা মুখ খুলে অন্যায় কিছু করেননি। দলের উচিত, পচা আলু বাদ দেওয়া। না হলে বস্তাটাই পচে যাবে।” স্থানীয় মাজিদা অঞ্চল সভাপতি ঝন্টু ঘোষের দাবি, “কর্মী-সমর্থকেরা চান, তোলাবাজির অভিযোগ নিয়ে দ্রুত নিরপেক্ষ তদন্ত হোক।”

তোলাবাজির মতো অভিযোগে নেতারা কবে কী ব্যবস্থা নেন, জানার অপেক্ষায় আছে দলের নিচুতলাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE