গঙ্গাকুমারী। বছর তেরোর এই কিশোরীকে নিয়েই সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার সরকারের মধ্যে টানাপড়েন তুঙ্গে উঠেছে।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে এই মেয়েটিকে পশ্চিমবঙ্গের একটি হোমে পাঠিয়েছিল বিহার সরকার। এখন তারাই ফের ওই নাবালিকাকে ফেরত চাওয়ায় বেঁকে বসেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। রাজ্যের অভিযোগ, এর পিছনে কোনও ষড়যন্ত্র রয়েছে। বিহারে ফিরে গেলে মেয়েটি আদৌ সুরক্ষিত থাকবে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন রাজ্যের কর্তারা।
অন্য দিকে, বাঁকুড়ার যে হোমে মেয়েটি ছিল, তার সম্পর্কে বিস্তর অভিযোগ তুলেছে গঙ্গাকুমারী নিজে ও বিহার সরকার। সব মিলিয়ে গত আড়াই মাস ধরে দু’পক্ষের বাকযুদ্ধ চলছেই। কিন্তু গঙ্গাকুমারী রয়ে গিয়েছে বাঁকুড়াতেই।
কোন পথে বাঁকুড়ায় এসে পৌঁছল এই নাবালিকা?
রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতর সূত্রে খবর, বছর ছ’য়েক আগে কাজের খোঁজে দিল্লিতে যান পেশায় রাজমিস্ত্রি রাজকুমার। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী রীণাদেবী ও মেয়ে গঙ্গাকুমারী। সেখানেই হারিয়ে যায় মেয়েটি। তার পর কারও সাহায্যে পৌঁছয় পটনায়। সেখানে এক মহিলা তাকে গায়ঘাট এলাকার নিশান্ত হোমে রেখে আসেন। পাঁচ বছর সেখানেই ছিল গঙ্গা। সে সময় বিহারের সমাজকল্যাণ দফতরের আধিকারিকদের কাছে বাবা ও মায়ের নাম জানিয়ে মেয়েটি বলেছিল, তাদের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের মালদহে। তা শুনে গত সেপ্টেম্বরে পটনার শিশুকল্যাণ সমিতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাহায্যে গঙ্গাকে লিলুয়া হোমে পাঠায়। তার পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে তাকে পাঠানো হয় সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত বাঁকুড়ার একটি হোম, নবদিগন্তে। টানাপড়েনের শুরু সেখান থেকেই।
সরকারি সূত্রের খবর, গত ৬ মার্চ বিহারের সমাজকল্যাণ সচিব রাজিল পুনহারি পশ্চিমবঙ্গের সমাজকল্যাণ সচিব রোশনী সেনকে চিঠি লিখে জানান, বিহারের রাজ্য সড়ক উন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অমৃত প্রত্যয়কে ফোন করে পটনার হোমে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে গঙ্গা। সে জানিয়েছে, বাঁকুড়ায় ওই হোমের পরিবেশ ভাল নয়।’ এই অবস্থায় বিহার সরকার গঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে চায় বলে জানান পুনহারি।
অমৃত প্রত্যয় এ বিষয়ে জানান, বিহারের বিভিন্ন হোম থেকে প্রতি বছর কিছু শিশুকে ‘দত্তক’ নিয়ে তাদের পড়াশোনা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও চাকরির দায়িত্ব নেয় তাঁদের নিগম। গঙ্গাও তাদেরই এক জন। তাঁর দাবি, গঙ্গা টেলিফোনে বলেছে, “নবদিগন্ত খুব খারাপ ছিল। ওখানে মেয়েদের লেখাপড়া শেখাত না। শুধু নোংরা-নোংরা কাজ করাত, জোর করে কলকাতায় নিয়ে যেত। আমি রাজি হইনি বলে ওরা মারত।” সে আরও বলে, “আমার এখানে ভাল লাগে না। আমি পটনায় ফিরতে চাই। ওখানে পড়াশোনা শিখে চাকরি করব।”
বিহার সরকারের চিঠি পেয়েও গঙ্গাকে ছাড়তে রাজি হননি এ রাজ্যের সমাজকল্যাণ সচিব রোশনী সেন। কিন্তু সেই সঙ্গেই নানা রকম সন্দেহ আর প্রশ্ন উঠে আসে গঙ্গাকে নিয়ে। রাজ্যের মহিলা ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজার বক্তব্য, “গঙ্গার বাড়ি বাংলায় বলে বিহার ওকে এখানে পাঠাল। আবার বছর না পেরোতেই ওকে ফেরত চাইছে। এই ব্যাপারটাই সন্দেহজনক।” গঙ্গাকে পাঠালেও সে ওখানে নিরাপদ থাকবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, “এই ঝুঁকি নেব না।” তিনি জানান, মালদহে মেয়েটির পরিবারের খোঁজ চলছে।
রাজ্যের শিশু অধিকার রক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান অশোকেন্দু সেনগুপ্তের দাবি, “কিছু গোলমাল পেয়েছি। সে সব অনেক কথা। অত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়।” বাঁকুড়ার শিশু নিরাপত্তা কমিটির চেয়ারম্যান শেখ মুরশালিনর বক্তব্য, “মেয়েটিকে ফেরাতে বিহারের অতিসক্রিয়তা সন্দেহজনক। তদন্তে অনুমান, গঙ্গা পটনাতে প্রেমঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিল। সেই সূত্রেই তাকে ফেরানোর মরিয়া চেষ্টা চলছে। কিন্তু ফিরলে ওর ক্ষতি হতে পারে।” এর পিছনে বিহার সরকারের ষড়যন্ত্রটা ঠিক কী, কেনই বা মেয়েটির নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে তার অবশ্য স্পষ্ট জবাব দেয়নি রাজ্য।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই মনোভাবে বিস্মিত বিহার সরকারের কর্তারা। রাজিল পুনহারির অভিযোগ, মেয়েটির কথা শুনে বিহার সরকারের তরফে একটি প্রতিনিধি দল বাঁকুড়ার ওই হোমে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কারও সঙ্গে গঙ্গাকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এতেই বোঝা যায় ওই হোমে কোনও গোলমাল রয়েছে।” তাঁর স্পষ্ট কথা, “ওই মেয়েটিকে ফেরত দিতেই হবে।”
গঙ্গাকে না ফেরানোর পণ করলেও বাঁকুড়ার ওই হোম নিয়ে অভিযোগ পেয়ে তদন্ত চালিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের শিশুকল্যাণ কমিটি। তারা গুরুতর কিছু অনিয়ম পেয়েছে। ফলে নবদিগন্ত বন্ধ করে সেখানকার মেয়েদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্য হোমে। গঙ্গাকে পাঠানো হয় বাঁকুড়ারই ‘নেতাজি স্কুল ক্লাব ও পাঠাগার’ নামে একটি হোমে। মন্ত্রী বলেন, “পরে ওকে লিলুয়া হোমে ফেরানো হয়েছে। সেখানে কোনও অভিযোগ নেই।”
প্রশ্ন উঠেছে, মেয়েটির অভিযোগ সরকারি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। আগেও রাজ্যের একাধিক হোম নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তা হলে কোন ভরসায় গঙ্গাকে এই রাজ্যেরই কোনও হোমে রেখে দেওয়াকে ‘নিরাপদ’ মনে করছেন সরকারি কর্তারা? এর কোনও স্পষ্ট জবাব মেলেনি। বিহারের সমাজকল্যাণ দফতরের পাল্টা অভিযাগ, গঙ্গার সূত্রে নবদিগন্ত হোমের অনৈতিক কাজকর্ম সামনে চলে আসায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার অস্বস্তিতে পড়েছে। তাই বিষয়টি ধামাচাপা দিতে গঙ্গাকুমারীকে বিহারে ফেরত পাঠাতে চাইছে না পশ্চিমবঙ্গ।
কিন্তু বাঁকুড়ার নবদিগন্ত হোমে তদন্ত করে যে ছবিটা উঠে এসেছে তা কম ভয়াবহ নয়।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy