Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতেই বদলি জেলাশাসক, পুলিশ সুপাররা

রবিবার মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পত বলেছিলেন, প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সোমবারই রাজ্যের এক জেলাশাসক এবং পাঁচ পুলিশ সুপারকে সরিয়ে দিল কমিশন। এ দিন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার (সিইও) সুনীল গুপ্ত জানিয়ে দেন, উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক-সহ পশ্চিম মেদিনীপুর-বীরভূম-বর্ধমান-মুর্শিদাবাদ-মালদহের পুলিশ সুপারকে সরিয়ে দেওয়া হল।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:১৩
Share: Save:

রবিবার মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পত বলেছিলেন, প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সোমবারই রাজ্যের এক জেলাশাসক এবং পাঁচ পুলিশ সুপারকে সরিয়ে দিল কমিশন।

এ দিন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার (সিইও) সুনীল গুপ্ত জানিয়ে দেন, উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক-সহ পশ্চিম মেদিনীপুর-বীরভূম-বর্ধমান-মুর্শিদাবাদ-মালদহের পুলিশ সুপারকে সরিয়ে দেওয়া হল। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের সঙ্গে ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপারের অতিরিক্ত দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন ভারতী ঘোষ। তাঁকে ওই পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রের রির্টানিং অফিসার, দক্ষিণ ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অলকেশ প্রসাদ রায় এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের অতিরিক্ত জেলাশাসক অরিন্দম দত্তকেও সরাতে বলেছে কমিশন।

কেন? নিরপেক্ষ হয়ে কাজ না করলে শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে, বারো দিন আগেই বলে গিয়েছিলেন উপ-নির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুৎসি। তার পরেও কয়েক জন প্রশাসনিক কর্তা নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে পারেননি বলে মনে করেছে কমিশন।

কিন্তু ১৯টি জেলার জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের মধ্যে থেকে কেন প্রথমে এই ছ’জনকেই সরানো হল?

কমিশন সূত্রের খবর, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার অনেক আগে থেকেই কমিশন এই অফিসারদের উপর নজর রাখছিল। ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পর এই অফিসারদের সম্পর্কে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ থেকে আলাদা ভাবে তথ্য সংগ্রহ শুরু করে কমিশন। পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফেও এই ছয় অফিসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ জমা পড়েছিল। রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের কাছেও এঁদের সম্পর্কে রিপোর্ট চেয়েছিল কমিশন। কমিশনের এক কর্তার দাবি, গোয়েন্দা বিভাগ, রাজনৈতিক দল এবং সিইও-র রিপোর্টের পাশাপাশি কমিশনের নিজস্ব সূত্রে আসা তথ্যে যে সব অফিসারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, কেবল তাঁদেরই সরিয়ে দিতে বলা হয়েছে। এই অফিসাররা নিয়মিত শাসক দলের নেতাদের কাছ থেকে ‘নির্দেশ’ নিচ্ছিলেন বলেও কমিশনের দাবি।

উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সঞ্জয় বনসল পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকেই শাসক দলের হয়ে কাজ করছেন বলে কমিশনের কাছে খবর ছিল। তাঁর উপরে প্রথম থেকেই নজর রেখেছিল কমিশন। হাবরার বিডিও নিগ্রহের ঘটনার পর কমিশন তাঁকে আর পদে রাখতে চায়নি। সিইও অফিসও তাঁর পক্ষপাতিত্ব নিয়ে একাধিক রিপোর্ট কমিশনে পাঠিয়েছিল। কমিশন জেনেছে, জেলাশাসক চাপ সৃষ্টি করেই বিডিও-কে অভিযোগ বদলাতে বাধ্য করেছিলেন। এবং দ্বিতীয় অভিযোগপত্রে যাতে বিধায়কের নাম না থাকে, তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও জেলাশাসকের ভূমিকা ছিল বলে কমিশনের তদন্তে ধরা পড়েছে।

কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ এম এইচ মির্জার বিরুদ্ধে তৃণমূলের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকার প্রমাণ মিলেছিল। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগই কমিশনকে জানিয়েছিল, পঞ্চায়েত ভোটে শাসক দলকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিলেন এসপি। বর্ধমান শহরে শাসক দলের ‘কাঞ্চন উৎসবে’ বক্তৃতা করেন পুলিশ সুপারের স্ত্রী।

গত ১১ মার্চ কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে চিঠি পাঠিয়ে বর্ধমান জেলা সিপিএম অভিযোগ করেছিল, পুলিশ সুপারের মদতেই জেলাজুড়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছে শাসক দল। সিপিএমের দাবি, গত ৩৪ মাসে তাদের ১৬ জন কর্মী তৃণমূলের লোকেদের হাতে খুন হয়েছেন। পুলিশ নিষ্ক্রিয় থেকেছে। গত সেপ্টেম্বরে বর্ধমান পুরসভার ভোটে জেতার পরে পুলিশ সুপারকে তৃণমূলের লোকজন মালা পরাচ্ছেন, এমন ছবিও কমিশনের কাছে পাঠিয়েছিল সিপিএম। মির্জার বদলির নির্দেশে তিনি যে কতটা ক্ষুব্ধ, জামালপুরের সভায় এ দিন প্রকাশ্যেই জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সভামঞ্চ থেকে তিনি বলেন, “বর্ধমানে মির্জা কত ভাল করেছে! ও কী অন্যায়টা করল যে পাল্টাতে হবে? ”

পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষের বিরুদ্ধেও ধারাবাহিক ভাবে শাসক দলের হয়ে কাজ করার অভিযোগ উঠেছিল। কমিশনের ফুল বেঞ্চ রাজ্যে এসে তাঁকে এ জন্য ভর্ৎসনাও করেছিল। গত বছর অগস্টে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশ সুপারের দায়িত্ব নেন ভারতী ঘোষ। একই সঙ্গে ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার ভারপ্রাপ্ত সুপারও তিনি। গোড়া থেকেই সিপিএমের অভিযোগ ছিল, বিরোধী কর্মী-সমর্থকদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। আর বিরোধীরা যখন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের নামে অভিযোগ করছেন, তখন নিষ্ক্রিয় থাকছে পুলিশ। ভারতীদেবীর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অভিযোগটি ওঠে গত ১৮ মার্চ। ওই দিন মেদিনীপুর শহরের জেলার তিন তৃণমূল প্রার্থী দেব, সন্ধ্যা রায় এবং উমা সরেন কর্মিসভা করেছিলেন। অভিযোগ, সভার পরে মেদিনীপুর সার্কিট হাউসে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন পুলিশ সুপার। ভারতীদেবী অবশ্য এই অভিযোগ মানেননি। কেশপুরে কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং তাই নিয়ে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধেই পাল্টা মামলা শুরু হয়েছে বলেও অভিযোগ পেয়েছিল কমিশন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সম্পত কলকাতায় এসে রবিবার ভারতীদেবীর কাছে এ সব নিয়ে কৈফিয়ত তলব করেছিলেন।

মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধেও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছিলেন। রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এফআইআর করার অভিযোগ ছিল। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যপ্রতিমন্ত্রী আবু হাসেম খান চৌধুরীও (ডালু) নির্বাচন কমিশনের কাছে হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে অভব্য আচরণের অভিযোগ করেছিলেন। কমিশন তা নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয়। কমিশন নিজস্ব সূত্রেও পুলিশ সুপারের পক্ষপাতিত্বের প্রমাণ পেয়েছিল। তার পরেই তাঁক সরানো হয়েছে। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপারকে সরানো নিয়ে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। জামালপুরের সভামঞ্চ থেকে তিনি বলেন, “অধীরবাবু (অধীর চৌধুরী) রিগিং করবেন, তাই নির্বাচন কমিশন এসপি-কে বদলি করেছে।”

নির্বাচন কমিশনের কোপে পড়েছেন মালদহের জেলা পুলিশ সুপার রাজেশ যাদবও। আবু হাসেম খান চৌধুরী রাজেশের বিরুদ্ধেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছিলেন। আবার কালিয়াচকে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে কমিশনও তাঁর উপর রুষ্ট হয়েছিল। যদিও পুলিশের বক্তব্য, কালিয়াচকের ১৬০০ দাগি অপরাধীদের মধ্যে প্রায় হাজার খানেক অপর

বীরভুমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল, তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মন্ডলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি দেরি করেছেন। অনুব্রতের বিরুদ্ধে জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা গত এক বছরে ছ’টি এফআইআর করলেও পুলিশ একটিতেও ব্যবস্থা নেয়নি। কমিশনে জেলাশাসক এই তথ্য জানান। তার পরেই পুলিশ সুপারকে সরিয়ে দেওয়া হল। যদিও জঙ্গলমহলে তাঁর কাজের অতীত অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে তাঁকে ফের ঝাড়গ্রামে পাঠিয়েছে কমিশন। কমিশন সূত্রের ইঙ্গিত, আরও কয়েক জন অফিসারের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। প্রয়োজনে তাঁদেরও নির্বাচনের কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। (সহ প্রতিবেদন: কিংশুক গুপ্ত, বরুণ দে, সৌমেন দত্ত, শুভাশিস সৈয়দ এবং পীযূষ সাহা)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jagannath chattapadhyay election commission
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE