বৈঠকটা দিল্লিতে। সোমবার বেলা ৩টেয়। বিষয় বিপর্যয় মোকাবিলা। সর্বোপরি বৈঠকটা অনেকাংশে এই রাজ্যকে নিয়ে। এ রাজ্যের জন্যই।
১০-১২ দিন আগেই বৈঠকের স্থান-কাল-বিষয় জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল নবান্নকে। তা সত্ত্বেও রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের সচিব এস সুরেশকুমারের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদন সংক্রান্ত ফাইল পৌঁছয় এ দিন বেলা দেড়টারও পরে! বৈঠক শুরুর মাত্র ঘণ্টা দেড়েক আগে। ফলে ইচ্ছে থাকলেও আলোচনায় হাজির থাকার জন্য শেষ পর্যন্ত দিল্লি পাড়ি দিতে পারেননি ওই আমলা।
এই গরহাজিরার জন্য হয়তো খেসারত দিতে হবে রাজ্যকেই। কারণ, রাজ্যে ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্তদের জন্য কেন্দ্রীয় অনুদানে আশ্রয় শিবির গড়ার কথা। উত্তর ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুরে সেই কাজে দেরি হচ্ছে কেন, তা জানতেই বিশেষ বৈঠক ডেকেছিল কেন্দ্র। সেখানে সচিব বা বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কোনও কর্তা হাজির না-থাকায় প্রকল্পের কাজ আরও গতি হারাবে বলেই আশঙ্কা করছেন সরকারি অফিসারেরা।
যে-ফাইল যথাসময়ে পৌঁছলে ওই আমলা বৈঠকের আগেই দিল্লি পৌঁছে যেতে পারতেন, সেটির এই শম্বুক-গতি কেন? কার বা কাদের ঢিলেমিতে সেটি বৈঠকের দেড় ঘণ্টা আগে হাতে পেলেন বিপর্যয় মোকাবিলা সচিব?
এক কথায় দায়ী ছুটি-সংস্কৃতি!
কেন্দ্রের ডাকা বৈঠকে আমলাদের হাজির থাকতে হলে মুখ্যমন্ত্রীর অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। গত বছরের শেষে মুখ্যমন্ত্রীর অফিসই এই ফরমান জারি করেছিল। সেই নির্দেশ মেনে কেন্দ্রের চিঠি পাওয়ার পরে গত সপ্তাহের গোড়াতেই সংশ্লিষ্ট দফতরের সচিব সুরেশকুমার দিল্লি যাওয়ার অনুমতি চান। নবান্নের খবর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবারেই সেই ফাইলে সই করেন। কিন্তু নবান্নের ১৫তলায় মুখ্যমন্ত্রীর অফিস থেকে নথিটি তেতলায় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরে পৌঁছতে লেগে যায় ছ’-ছ’টি দিন! ওই দফতরের অফিসারদের একাংশের বক্তব্য, এই জমানায় ছুটি-সংস্কৃতিতে কর্মসংস্কৃতি কী ভাবে হোঁচট খাচ্ছে, এটা তারই নমুনা।
বিশ্বব্যাঙ্ক, কেন্দ্র ও রাজ্যের একটি যৌথ প্রকল্পেও আশ্রয় শিবির গড়ার কথা। কিন্তু রাজ্যে সেই কাজও এগোয়নি। বিশ্বব্যাঙ্ক-কর্তারা তাই রাজ্যের কাজের মনোভাব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। এ বার আগেভাগে জেনেও রাজ্যের সচিব কেন্দ্রের বিশেষ বৈঠকে যেতে না-পারায় একই মনোভাব প্রতিফলিত হল বলে মনে করা হচ্ছে।
অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, একই বাড়িতে একটি ফাইলের ১২তলা পেরোতে ছ’দিন লাগল কী করে?
সরকারি কর্মীরা বলছেন, বুধবার ফাইলে সই করা হলেও তা যথাস্থানে পাঠানো হয়নি। বৃহস্পতিবার দোলের ছুটি ছিল। শুক্রবার হোলির ছুটি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। শনি-রবির ছুটির পরে এ দিনই ফের অফিস খুলেছে। তাই অনুমতিপত্র সচিবের কাছে পৌঁছতে দেরি হয়েছে।
সরকারি অফিসারদের একাংশের প্রশ্ন, বুধবার মুখ্যমন্ত্রীর সইয়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুমতিপত্র সংশ্লিষ্ট দফতরে পৌঁছল না কেন? কেনই বা এ দিন অফিস খোলার সঙ্গে সঙ্গে ফাইল গেল না সচিবের কাছে?? সরাসরি সদুত্তর দেওয়ার কেউ নেই।
বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের একাংশ বলছেন, উত্তর ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুরে ৩৫টি ঘূর্ণিঝড় ত্রাণ শিবির গড়ার কাজ আটকে রয়েছে। ২০১৪-য় সেই কাজ শেষ করার কথা ছিল। তা না-হওয়ায় এ দিন বাংলার জন্যই বিশেষ বৈঠক ডেকেছিলেন জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাতে সচিব বা উচ্চপদস্থ কর্তারা হাজির না-থাকায় কেন্দ্রীয় অনুদানের এই কাজ আরও পিছিয়ে যাবে।
এ দিনের বৈঠকে বাংলার কি কোনও প্রতিনিধিই ছিলেন না?
নবান্নের খবর, বৈঠকে কেউ না-থাকলে মুখ পুড়বে, এই আশঙ্কা করে তড়িঘড়ি দিল্লিতে রাজ্যের রেসিডেন্ট কমিশনারের দফতরে যোগাযোগ করা হয়। সেখান থেকে এক জন অফিসার ওই বৈঠকে যোগ দেন। কিন্তু বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের সচিব থাকলে যতটা কাজ হত, ওই অধস্তন অফিসারকে দিয়ে ততটা হয়নি বলেই মনে করছেন আমলাদের একাংশ।
বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের একাংশ বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে সুন্দরবন-সহ বাংলার উপকূল এলাকা যে বিপন্ন, পরিবেশবিদেরা বারবার তা জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক পরিবেশ গবেষণা সংস্থা আইপিসিসি-র রিপোর্টেও তা বলা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ত্রাণ শিবিরের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা সত্ত্বেও এমন বৈঠকে সচিবের যেতে না-পারার ঘটনা রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে বলেও মনে করছেন আমলাদের অনেকে। বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের এক কর্তা বলেন, “বিশ্বব্যাঙ্কের উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষা প্রকল্পেও এই ধরনের আশ্রয় শিবির গড়ার কথা। কিন্তু রাজ্য সেই কাজও শেষ করতে পারেনি। তাই কেন্দ্রের অনুদানে এই প্রকল্পের কাজ এগোলে উপকূলীয় জনজীবনের নিরাপত্তা কিছুটা অন্তত নিশ্চিত করা যেত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy