Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

প্রদেশের মান রেখে কপিলকে বার্তা কংগ্রেসের

প্রদেশ কংগ্রেসের তীব্র আপত্তির মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত আজ দলীয় মঞ্চ থেকে বার্তা দিতে বাধ্য হল কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। ২৪ নম্বর আকবর রোডে দলের সদর দফতরে সাংবাদিক বৈঠক করে বলা হল, “কপিল সিব্বল আইনজীবী। তিনি কোন মামলা লড়বেন, কোনটা লড়বেন না, সেটা তাঁর ইচ্ছে। কিন্তু এক জন অভিজ্ঞ ও বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা হিসেবে দলীয় কর্মীদের ভাবাবেগের বিষয়টিও তাঁর বিবেচনা করা উচিত।” সারদা মামলায় রাজ্য সরকারের হয়ে গত পরশু সওয়াল করেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সিব্বল। এআইসিসি সূত্র জানাচ্ছিল, হাইকম্যান্ডের সবুজ সঙ্কেত নিয়েই তৃণমূল সরকারের মামলা হাতে নেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই এর মাধ্যমে তৃণমূলের সঙ্গে ফের সমঝোতার বার্তা দেয় সর্বভারতীয় কংগ্রেস।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩৩
Share: Save:

প্রদেশ কংগ্রেসের তীব্র আপত্তির মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত আজ দলীয় মঞ্চ থেকে বার্তা দিতে বাধ্য হল কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। ২৪ নম্বর আকবর রোডে দলের সদর দফতরে সাংবাদিক বৈঠক করে বলা হল, “কপিল সিব্বল আইনজীবী। তিনি কোন মামলা লড়বেন, কোনটা লড়বেন না, সেটা তাঁর ইচ্ছে। কিন্তু এক জন অভিজ্ঞ ও বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা হিসেবে দলীয় কর্মীদের ভাবাবেগের বিষয়টিও তাঁর বিবেচনা করা উচিত।”

সারদা মামলায় রাজ্য সরকারের হয়ে গত পরশু সওয়াল করেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সিব্বল। এআইসিসি সূত্র জানাচ্ছিল, হাইকম্যান্ডের সবুজ সঙ্কেত নিয়েই তৃণমূল সরকারের মামলা হাতে নেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই এর মাধ্যমে তৃণমূলের সঙ্গে ফের সমঝোতার বার্তা দেয় সর্বভারতীয় কংগ্রেস। কিন্তু তাতে প্রবল চটে যান রাজ্য কংগ্রেসের নেতারা। কারণ তাঁদের আশঙ্কা, এতে রাজ্য কংগ্রেসের তৃণমূল-বিরোধী আন্দোলন লঘু হয়ে গেল। জোটের বার্তা যাওয়ায় উল্টে সুবিধে হয়ে গেল বিজেপির। গত কাল শহিদ মিনারের সভাতেও সেই উষ্মা চেপে রাখেননি প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরী। বলেন, “বাংলায় নিজের ক্ষমতায়, নিজের সংগঠনে আগামী দিনে কংগ্রেসকে শক্তিশালী করব। কারও ঘাড়ে উঠে দুনিয়া দেখতে চাই না, এটা দিল্লিকে পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি।”

রাজ্য কংগ্রেসের এই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখেই শেষমেশ এআইসিসি পিছু হটল বলে মনে করা হচ্ছে। এবং সে জন্যই আনুষ্ঠানিক ভাবে বলে দেওয়া হল, দলীয় কর্মীদের ভাবাবেগের কথা কপিলের মাথায় রাখা উচিত।

এখন প্রশ্ন হল, এর পরেও কি তৃণমূল সরকারের হয়ে মামলাটি লড়বেন কপিল? সনিয়া-রাহুল কি তাঁকে সে ব্যাপারে কোনও নির্দেশ দিয়েছেন? বারবার এই প্রশ্ন করা সত্ত্বেও কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছ থেকে কোনও সরাসরি উত্তর মেলেনি। উল্টে যে জবাব শোনা গিয়েছে, তাতে ধন্দ বেড়েছে। সাংবাদিক বৈঠকে যেমন কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা এর কোনও সদুত্তর দেননি। তেমনই পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত কংগ্রেস নেতা সি পি জোশী বলেন, “কপিলকে নিষেধ করার আমি কে! পশ্চিমবঙ্গের নেতা কর্মীদের অসন্তোষ সঙ্গত। শুধু সেটুকুই আমি কংগ্রেস সভানেত্রী ও সহ-সভাপতিকে জানিয়েছি।” কপিলকে দল ভর্ৎসনা করেছে এমন কথাও মানতে চাইছে না কংগ্রেস। রণদীপ বলেন, “দলের যেটুকু বলার ছিল, বলেছি। বিশেষণগুলি আপনাদের ব্যাখ্যা।”

এই অবস্থায় কপিল কী করতে পারেন? এআইসিসি-র আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পরে এই একাধিক সম্ভাবনার কথা ঘুরছে কংগ্রেসের মধ্যেই। এবং দলেরই বিভিন্ন নেতা বলছেন, কপিল এখন দুই সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন।

কপিল সিব্বল আইনজীবী। তিনি কোন মামলা লড়বেন, কোনটা লড়বেন না, সেটা তাঁর ইচ্ছে। কিন্তু কংগ্রেস নেতা হিসেবে দলীয় কর্মীদের ভাবাবেগের বিষয়টিও তাঁর বিবেচনা করা উচিত।

রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা, কংগ্রেস মুখপাত্র

প্রথম সম্ভাবনা, কপিল আর মামলাটি লড়লেন না। দলের এক শীর্ষ সারির নেতা আজ বলেন, এআইসিসি এই বার্তা দেওয়ার পর কপিলের পক্ষে মামলাটি লড়া সম্ভব নয়। কারণ তাতে মনে হবে যে, হাইকম্যান্ডের মতকেও তোয়াক্কা করছেন না কপিল। এই পরিস্থিতিতে কপিল কোন যুক্তিতে মামলাটি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন, সেটাই দেখতে চাইছে কংগ্রেসের এই অংশটি। রাজ্য কংগ্রেসের একটি সূত্রের দাবি, কপিল যাতে সরে দাঁড়ান, সে জন্য তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল।

অন্য একটি সম্ভাবনা হল, এআইসিসি-র তরফে বার্তা দেওয়ার পরেও মামলাটি লড়লেন কপিল। কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতাদের কয়েক জন বলছেন, কপিল তেমন কিছু করলে বুঝতে হবে, তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতা করতে অত্যন্ত আগ্রহী সনিয়া। তাই এক দিকে তিনি এআইসিসি-র মাধ্যমে প্রদেশ কংগ্রেসের উষ্মা কমানোর চেষ্টা করলেন। অন্য দিকে কেন্দ্রে তৃণমূলকে পাশে পাওয়ার ব্যাপারেও প্রক্রিয়া জারি রাখলেন। অর্থাৎ, কেন্দ্রে ও রাজ্যে দ্বিমুখী কৌশল নিয়েই চলতে চাইলেন তিনি।

তাৎপর্যপূর্ণ হল, ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেস নেতারা আজও বলেছেন, কপিল ভুল কিছু করেননি। দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, কপিল সারদা কাণ্ডে কোনও অভিযুক্তকে বাঁচাতে মামলাটি লড়ছেন না। তাঁর উদ্দেশ্য, তদন্তে যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হচ্ছে, তা রুখতে আদালতের নজরদারির ব্যবস্থা করা। এই দাবি, সুপ্রিম কোর্টে আব্দুল মান্নানরা আগেই জানিয়েছিলেন। তখন আদালত বলেছিল, এখনই নজরদারির ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। তবে সেই বিকল্প খোলা রইল। ফলে কপিলের আর্জিতে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। উল্টে এতে সিবিআইয়ের অপব্যবহার নিয়ে বিজেপি-বিরোধী অস্ত্র পাবে কংগ্রেস। তা ছাড়া ভুলে গেলে চলবে না, জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের বন্ধু বলতে কেউ নেই। কিন্তু বিজেপি সরকারকে সংসদে, বিশেষ করে রাজ্যসভায় বেকায়দায় ফেলতে গেলে তৃণমূলকে পাশে পাওয়া জরুরি। সি পি জোশীর মতো রাহুল-ঘনিষ্ঠ নেতাদের অনেকেই এই যুক্তি দিচ্ছেন।

যদিও এর পাশাপাশি রাজ্য কংগ্রেসের যে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেটাও বুঝতে পারছেন রাহুল গাঁধী। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, জাতীয় স্তরে বন্ধু খুঁজতে গিয়ে হাইকম্যান্ড তৃণমূলের পাশে দাঁড়ালে প্রদেশ কংগ্রেস যে সমস্যায় পড়ছে, তা রাহুলের কাছে স্পষ্ট। বস্তুত, কপিলের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে প্রদীপ ভট্টাচার্য, দীপা দাশমুন্সি, সোমেন মিত্রর মতো নেতারা আগেই হাইকম্যান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কপিলের বাড়িতে মুকুল রায়-চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যরা যে দিন গিয়ে বৈঠক করেছিলেন, তার পরের দিনই সনিয়া গাঁধীর কাছে নোট পাঠান দীপা। তাঁর বক্তব্য ছিল, এতে রাজ্যে কংগ্রেসের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। মদন-মুকুল-কুণালের মতো সারদা কলঙ্কিতদের রক্ষা করতে কেন ‘পার্টি’ হবে কংগ্রেস? এই একই যুক্তিতে কাল প্রদেশ কংগ্রেসেরসভাও বয়কট করেন দীপা। আজ জোশীর সঙ্গে দেখা করেন প্রদীপবাবু। সনিয়া-রাহুল এবং সি পি জোশীর কাছে নোট পাঠিয়ে অসন্তোষ জানান প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরীও।

কংগ্রেসের একটি সূত্র জানাচ্ছে, রাজ্য কংগ্রেসের এই অসন্তোষ নিয়ে আজ সনিয়া ও রাহুলের সঙ্গে বৈঠক করেন জোশী। তিনি জানান, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের প্রাসঙ্গিকতা ফেরাতে রাজ্য নেতাদের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। তার মধ্যেই কাল শহিদ মিনারে অধীরের সভায় প্রত্যাশা ছাপিয়ে বিশাল ভিড় হয়েছিল। কিন্তু কপিলের কারণে সেই সব প্রয়াস একেবারে চাপা পড়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া, কংগ্রেসের সুবিধার আশায় যে জোটের কথা ভাবা হচ্ছে, তাতে আদতে বিজেপিরই সুবিধা হবে। রাজ্যে তৃণমূল-বিরোধী ভোটের বেশির ভাগই তাদের বাক্সে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে। কংগ্রেস আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে। এর পরেই প্রকাশ্যে বার্তা দেওয়া হয়।

সেই বার্তার পর স্বাভাবিক ভাবেই এখন স্বস্তিতে রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্ব। অধীর বলেন, “হাইকম্যান্ড যে কংগ্রেস কর্মীদের ভাবাবেগকে গুরুত্ব দিলেন, এটাই ইতিবাচক।” আর প্রদীপবাবুর কথায়, “আশা করি, হাইকম্যান্ডের বার্তার পর জটিলতার অবসান হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

saradha scam kapil sibbal congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE