Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

পোশাক যত কম, টিকিট তত দামি ‘ডান্স হাঙ্গামা’র

রাতের অন্ধকার চিরে দিচ্ছে মঞ্চ থেকে ঠিকরে আসা লেসার লাইট। সাউন্ডবক্সে ‘বেবিডল ম্যায় সোনে দি’, ‘আজ বেশরমি কি নাইট’, ‘গন্ধি বাত’-এর তুমুল ঝঙ্কারে তাল মিলিয়ে নাচছে স্বল্পবাস কিশোরীরা। নাচের মুদ্রা যত চটুল, দর্শকদের সিটি তত জোরে। চলছে ‘ডান্স হাঙ্গামা’।

নির্মল বসু ও কৌশিক মিশ্র
বসিরহাট ও এগরা শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৪ ০৪:২১
Share: Save:

রাতের অন্ধকার চিরে দিচ্ছে মঞ্চ থেকে ঠিকরে আসা লেসার লাইট। সাউন্ডবক্সে ‘বেবিডল ম্যায় সোনে দি’, ‘আজ বেশরমি কি নাইট’, ‘গন্ধি বাত’-এর তুমুল ঝঙ্কারে তাল মিলিয়ে নাচছে স্বল্পবাস কিশোরীরা। নাচের মুদ্রা যত চটুল, দর্শকদের সিটি তত জোরে। চলছে ‘ডান্স হাঙ্গামা’।

উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট, সুন্দরবন লাগোয়া এলাকা, দেগঙ্গা, থেকে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা, পটাশপুর, ভগবানপুর, রামনগরের প্রত্যন্ত গ্রামে এই ‘ডান্স হাঙ্গামা’ রীতিমতো জনপ্রিয়। গ্রামীণ মেলা, পুজো থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামেও এই নাচের আসর বসে। বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে জামা (অনেক ক্ষেত্রে টাকাও) উড়িয়ে নাচতে থাকে দর্শকেরা। প্রকাশ্যেই চলে মদ্যপান। বসে জুয়ার আসর। হামেশাই এই ‘ডান্স হাঙ্গামা’ ঘিরে হাঙ্গামাও বাধে।

পুলিশ সূত্রের খবর, এ ধরনের অনুষ্ঠানের পিছনে একটি চক্র সক্রিয়। তাদের মতলব, গরিব ঘরের অল্পবয়সী মেয়েদের প্রথমে বিনা পয়সায় নাচ-গান শেখানো। তারপরে ভাল রোজগারের টোপ দিয়ে তাদের দিয়ে স্বল্পবাসে নাচতে বাধ্য করা। অল্পবয়সী মেয়েদের নাচের জন্য বিহার, উত্তরপ্রদেশে নিয়ে গিয়ে বিপদে ফেলা হয় বলেও অভিযোগ।

দলের মেয়েদের স্বল্পবাসে নাচানোর ব্যাপারে ‘ডান্স হাঙ্গামা’র মালিকদের একটা বড় অংশের বক্তব্য, “মেয়েদের গায়ে বেশি পোশাক থাকলে আমাদের অনুষ্ঠান কে দেখবে? লোকে মেয়েদের কম পোশাকে দেখতে চায়। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের সে ব্যবস্থা করতে হয়।” দলের মেয়েদের বিপদে ফেলার অভিযোগ অবশ্য মানেননি তাঁরা। উল্টে দাবি করেছেন মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন দলের লোকেরা ও অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা।

বছর কয়েক আগে বসিরহাটের দুই বাসিন্দা থানায় জানান, তাঁদের মেয়েদের নাচের শিক্ষক স্বরূপনগরের সুখেন মণ্ডল নাচের অনুষ্ঠানের নাম করে ১১ জন কিশোরীকে উত্তরপ্রদেশে নিয়ে গিয়েছে। পুলিশ সুখেনকে ধরে। কিশোরীদের ফিরিয়ে আনে। তারা পুলিশকে জানায়, বিভিন্ন মেলায় জোর করে তাদের চটুল নাচে বাধ্য করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে যৌন সংসর্গেও বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ।

এমন ঘটনার পরেও টাকার হাতছানি এবং সামগ্রিক সচেতনতার অভাবে ‘ডান্স হাঙ্গামা’ বন্ধ হয়নি। হাঙ্গামা পার্টির মালিকেরা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গিয়েছে। তাদের হয়ে স্থানীয় এজেন্টরাই বুকিং নেয় অনুষ্ঠানের। ১০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত দামে টিকিট বিক্রি হয়।

তবে টিকিটের দাম বেড়ে যায় নর্তকীর পোশাক কমলে। মেলায় মেলায় ঘুরে ‘ডান্স হাঙ্গামা’ দেখেন লাট্টু মুণ্ডা, কমল পাল, রতন ভুঁইয়ারা। তাঁদের অভিজ্ঞতা, “যেখানে পোশাক যত কম, সেখানে টিকিটের দাম তত চড়া। উদ্যোক্তারা চেষ্টা করে, যত কম পোশাকে মেয়েদের নাচানো যায়।”

বসিরহাটে এমনই এক ‘ডান্স হাঙ্গামা’ দলে কমলা দাস, রমিলা বিবিদের (নাম পরিবর্তিত) মেয়েরা নাচে। তাঁদের বক্তব্য, সংসারের যা অবস্থা, তাতে টাকা খরচ করে মেয়েদের নাচ শেখানোর কথা চিন্তা করতে পারেননি। মেয়েদের পড়াশুনোও হয়নি। লোকের বাড়ি কাজ করে উপার্জন করত। এক দিন এলাকারই এক পরিচিত মেয়েদের বিনা পয়সায় নাচ শেখানোর প্রস্তাব দেয়। নাচ শিখলে রোজগারও হবে, মাথা উঁচু করে বাঁচা যাবে ভেবে মেয়েদের নাচের ক্লাসে ভর্তি করে দেন তাঁরা। কয়েক মাসের মধ্যেই নাচ শিখে মেয়েরা ভাল রোজগার করছে। জানা গিয়েছে, এক-একটি অনুষ্ঠানে দু’-তিন ঘণ্টা নাচলেই ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা হাতেহাতে পায় কিশোরীরা। কমলা, রমিলার কথায়, “মেয়েরা কোথায়, কী পোশাকে নাচছে, তা ভেবে কী করব? টিভিতে, সিনেমায় অনেককেই তো নানা রকম পোশাকে নাচতে দেখি। কই, তখন তো কেউ কিছু বলে না!”

আবার অন্য মতও রয়েছে। অভিভাবক খালেক গাজি, কণিকা মণ্ডলেরা (নাম পরিবর্তিত) বলেন, “বিনা পয়সায় নাচ শিখে অনেক রোজগারের আশায় মেয়েদের ওই দলে দিয়েছিলাম। মাঝেমধ্যেই মেয়েরা বাড়ি ফিরে বলত, লোকের সামনে ছোট পোশাকে নাচতে ভাল লাগে না। কিন্তু দলের মালিকেরা ছাড়ে না। দল ছাড়লে ‘ফল ভাল হবে না’ বলে হুমকি দেয়।”

অভিভাবকেরা আরও জানান, নাচ শিখিয়ে প্রথমে গ্রাম-গঞ্জে ‘ডান্স হাঙ্গামা’ অনুষ্ঠানে ছোট পোশাকে নাচানো হয় মেয়েদের। পরে দলের মালিকেরা অনুষ্ঠান করানোর নামে কিশোরীদের ভিন্ রাজ্যে নিয়ে যায়। তার পর সেখান থেকে অনেকেই ফেরে না। কিন্তু মেয়েদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এবং অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের চাপে তারা ওই পেশা বেছেছে বলে পুলিশে যেতে সাহস পান না অভিভাবকেরা।

তবে এ ধরনের অনুষ্ঠান বন্ধে পুলিশের চাড় নেই বলেও অভিযোগ উঠেছে। এগরা ১ ব্লক তৃণমূল সভাপতি তথা স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান সিদ্ধেশ্বর বেরার অভিযোগ, “পুলিশে খবর দিলে লাভ হয় পুলিশেরই। উদ্যোক্তাদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে অভিযানের খবর পাঠিয়ে তারপরে তল্লাশিতে যায় পুলিশ।”

অভিযোগ মানেনি এগরা থানা। আর মহকুমাশাসক (এগরা) অসীম বিশ্বাস বলেন, “কখনও কখনও অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পরে ফোনে অভিযোগ পাই। এ ধরনের অনুষ্ঠান চলছে বলে খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গেই তা বন্ধ করা হবে।” এসডিপিও (বসিরহাট) অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মেলার অনুমতি দেওয়ার সময়ে এ ধরনের নাচের অনুষ্ঠান না করার জন্য উদ্যোক্তাদের নিষেধ করা হয়। তারপরেও কেউ যদি এ ধরনের নাচের আয়োজন করে, তা জানতে পারলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”

এই চাপান-উতোরের মধ্যেই অন্ধকারে রঙিন হয়ে ওঠে ‘হাঙ্গামা’র মঞ্চ। বাকি সবই ঢাকা পড়ে আঁধারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nirmal basu kaushik mishra dance hungama
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE