কার্যকাল ৬০ মাস। পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরেই তার প্রথম ৩০ মাস কোনও তলবি সভা ডাকা যাবে না প্রধানদের সরানোর জন্য! রাজ্য সরকার এই মর্মে বিল পাশ করাল শুক্রবার। এতে নির্বাচিত হওয়ার প্রথম আড়াই বছরের মধ্যে সংখ্যালঘু হয়ে পড়লেও গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান, উপ-প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদের সভাধিপতি, সহ-সভাধিপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা যাবে না। বিরোধীরা বলছেন, এটা গণতন্ত্রের বিরোধী। রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, বিরোধীদের স্বার্থেই এই পদক্ষেপ!
অনাস্থা প্রস্তাব এনে পঞ্চায়েতের দখল নিতে ‘ঘোড়া কেনাবেচা’ বেড়ে গিয়েছে বলে শুক্রবার বিধানসভায় মন্তব্য করেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। তাঁর ব্যাখ্যা, সাধারণত নিচুতলায় রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের দিকেই সবাই চলে যেতে চায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে বিরোধীদের বংশে বাতি দেওয়ার কেউ থাকবে না।
যদিও তাঁর দলেরই একটি অংশ বলছে, কেন্দ্রের ‘শাসক দল’ বিজেপিকে ঠেকানোই এর অন্যতম লক্ষ্য। রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে ২০১৩-র জুলাইয়ে। পঞ্চায়েতের যে আইন এত দিন চালু ছিল, তাতে পঞ্চায়েত-প্রধান বা উপ-প্রধানের বিরুদ্ধে এক বছরের মধ্যে অনাস্থা আনা যায় না। সেই সময় পেরোতেই পঞ্চায়েতে ক্ষমতা দখলের খেলা শুরু হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে। সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত (দ্বিতীয় সংশোধন) বিল, ২০১৪ পাশ করিয়ে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আড়াই বছর করল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
এই বিল তাই তৃণমূলের বিজেপি-মুখী নেতা-কর্মীদের প্রতিও স্পষ্ট বার্তা। কারণ, রাজ্যে শাসক দলের কাজে বিরক্ত হয়ে তৃণমূলের একাংশ বিজেপিতে ভিড়তে চাইছেন। বিজেপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলিও ২০১৬-তে রাজ্যে পরিবর্তনের পরিবর্তন আনতে ক্রমেই শক্তি বাড়াচ্ছে। তা সে দলের সদস্য সংগ্রহ অভিযানই হোক বা ছাত্র রাজনীতিতে মাটি কামড়ে লড়াই। তৃণমূলের নেতাদের একাংশ বলছেন, নয়া আইনে বিধানসভা ভোটের বছর অর্থাৎ ২০১৬-র গোড়া পর্যন্ত বিজেপির জনপ্রতিনিধি কেনাবেচা বা টোপ দেওয়া রোখা যাবে। পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রকারান্তরে সেটাই বলেছেন।
এটাকে গ্রামে-গ্রামে অনাস্থা নিয়ে তৃণমূলের প্রবল গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব বাগে আনার চেষ্টা বলেও মনে করছেন বিরোধী ও শাসক দলের অনেকে। দলের অন্দরে শৃঙ্খলার বার্তা দিয়েও এ সব বাগে আনা যাচ্ছে না দেখেই পঞ্চায়েতগুলিকে আইনি রক্ষাকবচ দেওয়া হল বলে তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা। ঘটনা হল, কিছু দিন আগেই ভাঙড়ের বেঁওতা গ্রাম পঞ্চায়েত দখল নেওয়ার চেষ্টাকে ঘিরে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। যার জেরে ভাঙড়ের প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক আরাবুল ইসলামকে ৬ বছরের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু নয়া পঞ্চায়েত আইনে দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও আরাবুলকে ভাঙড় পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির পদ থেকে আপাতত সরানো যাবে না।
এই সূত্র ধরেই ফরওয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক পরেশ অধিকারী এ দিন বলেন, “মুখের একটি কালো দাগ ঢাকতে সুব্রতবাবু পুরো মুখটাই কালো করে দিলেন।” বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হবে এতে।” কংগ্রেস বিধায়ক নেপাল মাহাতোর কটাক্ষ, “সরকারি টাকায় কী ভাবে দল চালাতে হয়, তা দেখিয়ে দিয়েছে তৃণমূল।” সিপিএমের আনিসুর রহমান বলেন, “আড়াই বছরের আগে পঞ্চায়েত সংখ্যালঘু হয়ে পড়লেও অনাস্থা আনা যাবে না। এটা গণতন্ত্রের বিরোধী।”
পঞ্চায়েত আইন বদলের কারণ হিসেবে সরকারি ভাবে অবশ্য বলা হয়েছে, পঞ্চায়েত সংস্থাগুলির স্থায়িত্ব রক্ষা করে জন পরিষেবার উন্নয়ন এবং প্রধানদের অপসারণ করার নিয়মের ‘অপব্যবহার’ আটকানোর জন্যই আইনে এই সংশোধন করা হচ্ছে। বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, বিজেপি এবং এসইউসি বিধায়করা সংশোধনীর বিরোধিতা করলেও বিলটি নিয়ে ভোটাভুটির সময় কংগ্রেস ও বিজেপি-র সদস্যরা তাতে অংশ নেননি।
পঞ্চায়েতমন্ত্রী অবশ্য বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে বলেছেন, “নয়া নিয়মে বিরোধীরাই লাভবান হবেন। কারণ, চলতি নিয়মে এক বছর পরে অনাস্থা আনার সুযোগ নিয়ে ‘ঘোড়া কেনাবেচা’ অনেক বেড়ে গিয়েছে। বেড়েছে স্বজনপোষণ, দুর্নীতি ও কাজের গতিহীনতা।” যদিও তৃণমূলেরই অনেকে মানছেন, নিচু তলায় গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে উত্তর দিনাজপুর, আলিপুরদুয়ারের মতো জেলা পরিষদ বিরোধী দল ভাঙিয়ে সবই দখল নেওয়া হয়ে গিয়েছে তৃণমূলের। আলিপুরদুয়ারের নাম না করে খোদ সুব্রতবাবুও বলেন, “ওখানে তৃণমূলের মাত্র এক জন প্রতিনিধি ছিলেন। কিন্তু বিরোধীরা দল ভেঙে চলে আসায় জেলাপরিষদ তাঁদের দখলে চলে আসে। বামেরা তা আটকাতে পারেনি।”
পরিস্থিতি বুঝে ভবিষ্যতে নতুন নিয়ম বদলেরও পথ খোলা রাখছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। জানিয়েছেন, এটা পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা। যদি দেখা যায় এর পরিবর্তনের প্রয়োজন, সবার সঙ্গে কথা বলে ফের আইনের সংশোধন করা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy