Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

পরিবর্তনের হাওয়ায় আশাতীত ভিড়, উজ্জীবিত সঙ্ঘ পরিবার

নভেম্বরের গোড়ায় পথে নেমেছিল ছাত্ররা। তার পর ৩০ নভেম্বর রাজ্যের শাসক দলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে আদালত থেকে ধর্মতলায় সভা করার অনুমতি আদায় করে নিয়েছিল রাজ্য বিজেপি। সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের উপস্থিতিতে সেই সভায় জনসমাবেশের নিরিখেও তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন রাহুল সিংহেরা। আর শনিবার ধর্মতলায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ডাকে শহিদ মিনারে সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবতের জনসভা বুঝিয়ে দিল, তৃণমূলের পদস্খলনের সুযোগ নিয়ে ক্রমেই শক্তি বাড়ছে গেরুয়া শিবিরের।

শহিদ মিনার ময়দানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভায় মোহন ভাগবত এবং প্রবীণ তোগাড়িয়া। ছবি: দেবাশিস রায়।

শহিদ মিনার ময়দানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভায় মোহন ভাগবত এবং প্রবীণ তোগাড়িয়া। ছবি: দেবাশিস রায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৪০
Share: Save:

নভেম্বরের গোড়ায় পথে নেমেছিল ছাত্ররা। তার পর ৩০ নভেম্বর রাজ্যের শাসক দলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে আদালত থেকে ধর্মতলায় সভা করার অনুমতি আদায় করে নিয়েছিল রাজ্য বিজেপি। সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের উপস্থিতিতে সেই সভায় জনসমাবেশের নিরিখেও তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন রাহুল সিংহেরা। আর শনিবার ধর্মতলায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ডাকে শহিদ মিনারে সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবতের জনসভা বুঝিয়ে দিল, তৃণমূলের পদস্খলনের সুযোগ নিয়ে ক্রমেই শক্তি বাড়ছে গেরুয়া শিবিরের।

এ দিন ভিএইচপির সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত সভায় আশাতীত ভিড় দেখে উচ্ছ্বসিত প্রবীণ তোগাড়িয়া বলেন, “আর বেশি দিন নেই, বাংলাও পুরো গেরুয়া হয়ে যাবে মনে হচ্ছে!” বস্তুত, রাজ্যে শাসক দলেরও অনেকেই একান্তে কবুল করছেন, তাঁদের সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা যত দ্রুত কমছে, তার চেয়েও যেন বেশি হারে ভিড় বাড়ছে বিজেপি-তে।

কেন এমন জনসমাগম? পরিষদ নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, পশ্চিমবঙ্গের বাতাসে এখন প্রকৃত পরিবর্তনের গন্ধ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে যে যেখানে কথা বলবে, সেখানেই মানুষ জড়ো হবেন।

কিন্তু এ রাজ্যে খাতায়কলমে এখনও তো বামেরাই মূল বিরোধী শক্তি। তা হলে তৃণমূলের ক্ষয়ে তাদের সভা-সমাবেশে যত ভিড় বাড়ছে, বিজেপির সভায় তার চেয়ে বেশি বাড়ছে কেন? অনেকের মতে, বিপর্যয়ের ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বামেরা। না আদর্শগত ভাবে, না সাংগঠনিক ভাবে। তা ছাড়া, সাড়ে তিন দশকের শাসনের বোঝা কিছু ক্ষেত্রে এখনও বয়ে চলতে হচ্ছে তাঁদের। অন্য দিকে, মোদী-ঝড়ে ভর করে রাজ্যে ক্রমশ বিস্তার ঘটছে বিজেপির। নতুন শক্তি হিসেবেই তারা মানুষের আস্থাভাজন হয়ে উঠছে।

গেরুয়া শিবিরের অবশ্য এ-ও ব্যাখ্যা যে, মমতা সরকারের ‘সংখ্যালঘু তোষণ’ তাঁদের বিস্তারে সাহায্য করছে। সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে সঙ্গে পেতে মমতা তাঁদের একাংশকে তোষণ করছেন, এমন অভিযোগ অনেক আগেই উঠেছে। বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণ বা ইমাম বা মোয়াজ্জিনদের জন্য ভাতার ঘোষণা মূলত ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির দিকে তাকিয়েই। যদিও এই সব উপহারে সামগ্রিক ভাবে সংখ্যালঘুদের মন ভোলানো যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তাঁদের মতে, মমতার সরকার সম্পর্কে সাধারণ ভাবে মানুষের যে বিরূপতা, সংখ্যালঘু সমাজের সামগ্রিক মনোভাব তার বিপরীত নয়।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভা। শনিবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পূর্বাঞ্চলের সংগঠন সম্পাদক শচীন্দ্রনাথ সিংহ অবশ্য বলছেন, বাম জমানায় সংখ্যালঘু তোষণ হলেও তৃণমূল আমলে তা বহু গুণ বেড়েছে। তার পর খাগড়াগড় বিস্ফোরণে জড়িত জামাত জঙ্গিদের সঙ্গে তৃণমূলের যোগাযোগ প্রকাশ্যে আসার জেরে এ রাজ্যের হিন্দুরা আর নিজেদের নিরাপদ বলে মনে করছেন না। তাঁরা সরকারের পরিবর্তন চাইছেন। সে জন্যই পরিষদের মতো সংগঠনের কর্মসূচিতে ভিড় বাড়ছে। শচীনবাবুরর কথায়, “যত সংখ্যালঘু তোষণ হবে, ততই হিন্দুরা আমাদের দিকে আকৃষ্ট হবে এটাই তো স্বাভাবিক।”

এই ব্যাখ্যার সমর্থন মিলছে এ দিন মোহন ভাগবতের বক্তৃতাতেও। আরএসএস প্রধান সাধারণত জনসভায় ভাষণ দেন না। এর আগে কলকাতা, কল্যাণী, রায়গঞ্জে প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিলেও তা ছিল সঙ্ঘকর্মীদের নিজস্ব কর্মসূচি। কিন্তু এ বারের মতো রীতিমতো প্রচার চালিয়ে, ফ্লেক্স টাঙিয়ে, বাস-লরি ভর্তি করে লোক এনে কখনও জনসভা করেননি। এ দিন তিনি বলেন,“লাউডস্পিকারের সামনে আমি বলি না। আজ এত জোর গলায় বলছি কারণ, আপনাদের সংখ্যা দেখে ভরসা পাচ্ছি। বাংলাতেও হিন্দু জাগ্রত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।”

বস্তুত, এ দিনের সভার থিম ছিল ‘আমরা সবাই হিন্দু’। সভার বেশ কিছু দিন আগে থেকেই ওই স্লোগান লিখে প্রচুর সংখ্যক অতিকায় ফ্লেক্স টাঙানো হয়েছিল কলকাতা শহর ও শহরতলিতে। ডাক দেওয়া হয়েছিল ‘শহিদ মিনার চলো’। ঠিক যেমন ভাবে রাজনৈতিক দলগুলি ব্রিগেড বা রানি রাসমণি অ্যাভেনিউয়ে সভার তোড়জোড় করে। রাজনৈতিক দলগুলির মতোই এ দিন পরিষদের সভাতেও লোক এসেছিল বাস, ম্যাটাডোর, চার চাকার গাড়ি ভাড়া করে। পরিষদ নেতারা জানাচ্ছেন, এ দিন শ’তিনেক বাস, ম্যাটাডোর বোঝাই করে মানুষ এসেছিলেন। এ ছাড়া চার চাকার গাড়ি এসেছিল প্রায় ২০০টি। সব মিলিয়ে লোক হয়েছিল পঞ্চাশ হাজার। এর আগে পরিষদ শেষ যে কর্মসূচিতে আমজনতাকে ডাকা হয়েছিল, সেটা ছিল রামমন্দির আন্দোলনের সময়। তখন ১০-১৫ হাজারের বেশি লোক হয়নি।

পরিষদ নেতৃত্বের দাবি, রাজ্যের সব জায়গা থেকে কর্মীরা এ দিনের সভায় আসেননি। কেবল কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান এবং নদিয়ার কিছু অংশের কর্মীরা যোগ দিয়েছিলেন। তাতেই এত ভিড় হয়েছে। সারা রাজ্য থেকে লোক আনলে কলকাতা অচল হয়ে যেত বলে দাবি করেছেন তাঁরা।

পরিষদ নেতাদের বক্তব্য, এ দিন সভায় যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের প্রায় অর্ধেকই যুবক-যুবতী এবং নতুন সদস্য। সাধারণ মানুষও ছিলেন বিপুল সংখ্যায়। সভায় লোক আনার জন্য রাজ্য নেতৃত্বের পক্ষ থেকে কোনও আর্থিক সাহায্য করা হয়নি। যাঁরা এসেছেন, তাঁরা নিজেদের পকেট থেকে টাকা খরচ করে স্থানীয় ভাবে বাস ভাড়া করেছেন। খাবারের বন্দোবস্তও করেছেন নিজেরাই। উপরন্তু সভার জন্য চাঁদাও দিয়েছেন। পরিষদ নেতৃত্বের বক্তব্য, এর পরেও এই ভিড় নিঃসন্দেহে সংগঠনের পক্ষে উৎসাহব্যঞ্জক। রাজ্যের মানুষের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগিয়ে যে সংগঠনও আরও জোরদার করতে চান বিজেপি নেতৃত্ব।

পরিবর্তনের সাড়ে তিন বছরের মধ্যে রাজ্যে যে ফের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা মেনে নিচ্ছেন বামেরাও। কিন্তু এ বার গেরুয়া শিবিরের পালে হাওয়া দেখে স্বাভাবিক কারণেই শঙ্কিত তাঁরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, “পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো এখানে ওঁরা হিন্দু তালিবান করার চেষ্টা করছেন। এর জন্যই বামপন্থীদের দুর্বল করার চেষ্টা হচ্ছে। তৃণমূল নেত্রী যে নীতি নিয়ে চলছেন, তার জন্যই এই ধরনের শক্তি আরও উৎসাহ পাচ্ছে।” প্রবীণ বাম নেতা আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার মতে, “প্রথমে বামফ্রন্টের সংশোধনবাদী রাজনীতি এবং পরে ৩০ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করতে সংখ্যালঘুদের নিয়ে তৃণমূল যে রাজনীতি শুরু করে, তার জন্য গেরুয়া শক্তি এ রাজ্যে মাথা তুলছে।”

আর তৃণমূল অন্তত প্রকাশ্যে পরিষদের সভাকে কোনও গুরুত্ব দিতেই নারাজ। তৃণমূল নেত্রীর নির্দেশে দলের বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “আজ পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে কালো দিন।

এত দিন সারা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল। সেটা আজ আমরা হারালাম।” তাঁর বক্তব্য, এই ধরনের জাতপাতের রাজনীতির বিরোধিতায় সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা সরকারের ভরসায় থাকলে চলবে না।

কিন্তু ঘটনা হল, এ দিনের সভায় মোহন ভাগবত বা প্রবীণ তোগাড়িয়া কেউই নতুন কোনও কথা বলেননি। হিন্দুত্ব, অনুপ্রবেশ ইত্যাদি প্রসঙ্গে যা বলেছেন, সে সবই তাঁদের ঘোষিত এবং চিরকালের বক্তব্য। তা হলে তৃণমূল নেতৃত্বের এ দিনকে ‘কালো দিন’ আখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে কেন?

প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি পরিবর্তনের ইঙ্গিত পেয়েই শাসক দলের দিন ভয়ে কালো হয়ে যাচ্ছে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bjp mohan bhagwat rahul sinha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE