Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রসঙ্গ যাদবপুর

ফেসবুকে ‘প্রায়শ্চিত্ত’! জবাব মিলছে ধিক্কারে

রাতারাতি ভোল বদলের চেষ্টা বা চাপে পড়ে ‘প্রায়শ্চিত্তের’ ভাবনা রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে নতুন নয়। কিন্তু আমজনতার একটা বড় অংশ যে এই প্রবণতাকে কতটা অপছন্দ করে, ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে তা প্রকাশ্য। ঠিক এমনটাই ঘটল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বদল ঘিরেও। যাদবপুরে গিয়ে ভিসি-র পদত্যাগের বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্ত হওয়া সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত কি না, তা অন্য বিতর্ক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২০
Share: Save:

রাতারাতি ভোল বদলের চেষ্টা বা চাপে পড়ে ‘প্রায়শ্চিত্তের’ ভাবনা রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে নতুন নয়। কিন্তু আমজনতার একটা বড় অংশ যে এই প্রবণতাকে কতটা অপছন্দ করে, ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে তা প্রকাশ্য। ঠিক এমনটাই ঘটল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বদল ঘিরেও।

যাদবপুরে গিয়ে ভিসি-র পদত্যাগের বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্ত হওয়া সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত কি না, তা অন্য বিতর্ক। কিন্তু তা ঘিরে ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাতারাতি ভোল বদলে যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানো কিংবা ‘হোক কলরব’-এর পাল্টা তৈরি হওয়া ‘হোক গর্জন’ পেজে মমতার ত্রাতা হয়ে ওঠার ঘোষণা প্রশংসা বা সমর্থন পাওয়া দূরে থাক, বরং তীব্র শ্লেষে বিদ্ধ হয়েছে। কারও কাছে হয়ে উঠেছে হাসির খোরাকও।

১৬ সেপ্টেম্বর রাতে যাদবপুরে আন্দোলনরত পড়ুয়াদের উপরে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে উত্তাল কলরব-এর দিনগুলোয় অভিষেক তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছিলেন, ‘মদ, গাঁজা, চরস বন্ধ, তাই কি প্রতিবাদের গন্ধ?’। সোমবার অনশনরত পড়ুয়াদের কাছে গিয়ে মমতার ঘোষণার পরে সেই অভিষেকই তাঁর পেজে লেখেন ‘টিল সিক্স ইয়ার্স এগো আই ওয়াজ আ স্টুডেন্ট মাইসেল্ফ, সো আই নো হাউ ইট ফিল্স টু অ্যাচিভ সামথিং ওয়ান স্ট্রাইভস আরডেন্টলি...’ যাদবপুরের আন্দোলনের জয়ে নিজের অভিনন্দন, কুনির্র্শ জানাতে চাওয়া সেই পোস্টের কমেন্টে সমর্থনের বদলে পাল্লা ভারী হয়েছে সমালোচনারই। ওই পেজে নিজেকে জননেতা হিসেবে জাহির করা অভিষেকের বক্তব্যের দিকে আঙুল তুলে কেউ বলেছেন, ‘এ আবার কোন নাটক?’, কেউ বা তীব্র তিরষ্কারে মনে করিয়ে দিয়েছেন আগের পোস্টের কথা। তাঁর আকস্মিক ভোলবদল এখন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে অন্যতম হাসির খোরাক। শুধু হাস্যাস্পদ নন, এই সব নেতা আদতে কতটা বিশ্বাসযোগ্য, জনতা প্রশ্ন তুলেছে তা নিয়েও।

সোমবার মমতার কার্যকলাপের পরে ‘হোক গর্জন’ পেজে যাদবপুরের অচলাবস্থা কাটানোর কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীকেই। এই পেজেই আগে ‘কলরব’ নিয়ে সমালোচনার অন্ত ছিল না। সোমবারের পোস্টে মমতার প্রশংসার বদলে সোজাসুজিই পেজ বদলের দাবি তুলেছেন কেউ কেউ। ক্ষোভ-শ্লেষ তো বটেই, হাসি-ঠাট্টারও অন্ত ছিল না।

‘হোক গর্জন’ না হয় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে তৈরি একটি ‘পেজ’। সেখানে অংশ নিয়ে নিজের কথা বলতে পারেন যে কেউ। কিন্তু অভিষেক তো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তিনি যখন বিতর্ক উস্কে দিয়ে কিছু বলেন এবং তার পরে দ্রুত অবস্থান বদলান, তখন অবধারিত ভাবেই যে প্রশ্নটা সামনে আসে তা হল— এমন বিতর্ক যে হবে তা তো তাঁর না জানার কথা নয়। তবে কোন মানসিকতা থেকে এত দ্রুত এমন অবস্থান বদলের ঝুঁকি নিলেন তিনি? মনোবিদ জ্যোতির্ময় সমাজদার বলেন, “এখন অধিকাংশ নেতারই নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখার কোনও দায় নেই। তাই নিজেদের স্বার্থের তাগিদে তাঁরা ১৮০ ডিগ্রি কেন, ৩২০ ডিগ্রিও ঘুরতে পারেন। মানুষ সম্মান করছে কি না, তা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। কারণ তাঁরা জানেন, যত দিন দল ক্ষমতায় আছে, তাঁদের অস্তিত্ব শুধু তত দিনই।”

রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-তামাশা আগেও হত। কিন্তু সেটা ছিল মূলত কার্টুনে। এখনকার মতো এমন খোলামেলা হাসি-মস্করা-বিদ্রূপের চল কিছু দিন আগে পর্যন্তও ছিল না। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের দেওয়ালই এ যুগে হয়ে উঠেছে সেই সব প্রতিক্রিয়া প্রকাশের তাৎক্ষণিক জায়গা। যে কোনও ঘটনার প্রথম প্রতিক্রিয়া ধরা থাকছে এই সব সাইটেই। সে অর্থে এই দেওয়ালগুলোই এখন অনেকটাই সমাজের আরশি। এখন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের দৌলতে কোনও কিছুতেই রাখঢাক নেই। মুহূর্তে হাজির করা হচ্ছে আগের ‘স্টেটমেন্ট’। ভোল বদলানো বক্তব্যের পাশাপাশি সেই পুরনো বক্তব্যকে তুলে ধরে নেতাদের রীতিমতো দুরমুশ করছেন আমজনতা। যেমন হয়েছে এ ক্ষেত্রে। অভিষেকের ফেসবুক পেজে তাঁর আগের বক্তব্য তুলে ধরে জনতা সোজাসাপ্টা জানতে চেয়েছে, তা হলে কোন অভিষেক আসল?

মনোবিদ মোহিত রণদীপ বলেন, “নেতারা ভাবেন, সাধারণ মানুষের স্মৃতি খুব দুর্বল। তাই এই ভোল বদল মানুষ বেশি দিন মনে রাখবেন না। তা ছাড়া বাজারে খবরেরও অভাব নেই। নতুন খবর এসে পুরনোকে ভুলিয়ে দেবে। সেই ধারণা এ বার বদলাতে হবে। এখন সব কিছু রেকর্ড করা থাকছে। কোনটা মুখ, কোনটা মুখোশ— মানুষ ঠিক বুঝে নিচ্ছে।”

মনোবিদ বা সমাজবিদরা একবাক্যে জানিয়েছেন, রাজনৈতিক নেতাদের কৌশলগত অবস্থান-বদল এখন মানুষ ধিক্কার দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে। যাদবপুর তা আরও এক বার প্রমাণ করল।

সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায় বলেন, “আগ বাড়িয়ে কোনও কথা বলা এবং বিপদ বুঝে তা গিলে ফেলতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হওয়া এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কোথায়, কী এবং কতটুকু বলতে হবে, কখন চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় সেই বোধটাই তাঁদের নেই। তাই জনসমক্ষে বারবার তাঁদের হেয় হতে হয়।”

সমাজতাত্ত্বিক অভিজিৎ মিত্র সোজাসুজিই বলছেন, “সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে সাধারণ মানুষের এই বক্তব্যগুলোতেই পরিষ্কার নেতাদের বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে, আমজনতা বোকা নয়। কোনটা মুখ, কোনটা মুখোশ বোঝার ক্ষমতা তাঁদের আছে। জনতার এই বক্তব্যগুলো যত স্পষ্ট হয়, ততই মঙ্গলের।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE