Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

বিকাশই নেই, বিসর্জনে বাদ ধুমধাম

গ্রামের পুজোর সব আয়োজনের পুরোভাগে ছিলেন তিনিই। প্যান্ডেল গড়া থেকে প্রতিমা, সবেতেই তিনি তদারকি করেছেন। ধুমধাম করে বিসর্জনের সব আয়োজনও পাকা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু, সেই বিসর্জনে আর থাকা হল না ইঁদপুরের হাটগ্রামের অঞ্চল তৃণমূল সভাপতি বিকাশ দত্তের। শনিবার রাতে বিকাশবাবু ও তাঁর বৃদ্ধ বাবার গলার নলি কাটা দেহ উদ্ধারের পরে গোটা হাটগ্রামে বিষাদের ছায়া।

এই জলাশয়ে পাড়েই মিলেছিল দেহ।

এই জলাশয়ে পাড়েই মিলেছিল দেহ।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
ইঁদপুর শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৫
Share: Save:

গ্রামের পুজোর সব আয়োজনের পুরোভাগে ছিলেন তিনিই। প্যান্ডেল গড়া থেকে প্রতিমা, সবেতেই তিনি তদারকি করেছেন। ধুমধাম করে বিসর্জনের সব আয়োজনও পাকা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু, সেই বিসর্জনে আর থাকা হল না ইঁদপুরের হাটগ্রামের অঞ্চল তৃণমূল সভাপতি বিকাশ দত্তের। শনিবার রাতে বিকাশবাবু ও তাঁর বৃদ্ধ বাবার গলার নলি কাটা দেহ উদ্ধারের পরে গোটা হাটগ্রামে বিষাদের ছায়া। সমস্ত বাহুল্য বাদ দিয়ে সেই শোকের আবহেই নমো নমো করে বিসর্জন হয়েছে গ্রামের দুর্গা প্রতিমার।

রবিবার সকালে গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের মোড়ে মোতায়েন রয়েছে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী। গ্রামবাসীরা সেখানে জটলা করেছেন। সবারই মুখ থমথমে। স্বামী, ছেলেকে হারিয়ে গ্রামের রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মতো গড়াগড়ি খাচ্ছেন বিকাশবাবুর মা স্বর্ণময়ী দত্ত। তাঁকে আগলে রেখেছেন গ্রামের অন্য মহিলারা। বিকাশবাবুর স্ত্রী নমিতাদেবী বাড়ির উঠোনে কাঁদতে কাঁদতে মাঝেমাঝেই জ্ঞান হারাচ্ছেন। নিহত তৃণমূল নেতার স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ে সজল ও মৌসুমী কখনও ঘরের ভিতরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। কখনও আবার মাকে সান্ত্বনা দিতে বেরিয়ে আসছে উঠোনে।

কান্না ভেজা গলায় তারা বলল, “শনিবার রাত দশটা পর্যন্ত বাবার ফোনে মাঝেমাঝে রিং হয়েছে। কিন্তু, কেউ ধরেনি। তারপর আর ফোন পাইনি।” তাদের কথা বলার সময়েই ওই বাড়িতে এলেন বাঁকুড়া জেলা তৃণমূলের সভাপতি অরূপ খাঁ এবং জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী। তাঁদের পা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন স্বর্ণময়ীদেবী। বিকাশবাবুর দাদা নীতীশ দত্ত-ও ধরা গলায় দুই নেতাকে বললেন, “ভাই এ ভাবে খুন হয়ে গেল। কী করে ওর স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে সান্ত্বনা দেব, আপনারা বলে দিন।” শাসকদলের দুই নেতাই নিরুত্তর। জেলা সভাপতি কিছু পরে বললেন, “অপরাধীরা শাস্তি পাবেই! কেউ ছাড়া পাবে না!”

এলাকায় ভালই প্রভাব ছিল বিকাশবাবু। গ্রামবাসীদের বড় অংশই জানাচ্ছেন, গ্রামের কেউ সমস্যায় পড়লে, নিহত তৃণমূল নেতা তাঁর পাশে দাঁড়াতেন। এলাকায় কেউ অসামাজিক কাজে জড়িত থাকলে বিকাশবাবু তার প্রতিবাদ করতেন। “সেটা করতে গিয়েই হয়তো উনি কিছু লোকের আক্রোশের শিকার হয়েছেন।”মন্তব্য করলেন এক গ্রামবাসী। এলাকার তৃণমূল কর্মীদেরও সেটাই ধারণা। ইঁদপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি অসিত লায়েকের কথায়, “বিকাশ ছিলেন ওই অঞ্চলে আমাদের দলের সম্পদ। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার জন্যই আমরা বরাবর এই এলাকায় ভোট বেশি পেতাম।” বিকাশবাবুর খুন হওয়া যে হাটগ্রামে তাঁদের দলের পক্ষে বড় ‘ধাক্কা’, তা আড়ালে মানছেন জেলা তৃণমূল নেতাদের একাংশও।

নিহত বিকাশ দত্ত।

শোকার্ত মা।

এ দিন গ্রামবাসীরা সকাল থেকেই ভিড় জমিয়েছিলেন শ্মশান সংলগ্ন এলাকায়, যেখানে খুনের ঘটনা ঘটেছে। দুর্গামণ্ডপ ছিল নিঝুম। ঘটনাস্থলে একটি আধপোড়া কাঠ পড়ে রয়েছে। তার চারপাশে চকে আঁকা সাদা গণ্ডী। গ্রামের লোক এবং পুলিশের ধারণা, ওই আধপোড়া কাঠটা ছুড়েই প্রথমে বিকাশবাবুর উপরে হামলা চালায় আততায়ীরা। যে ডোবার ধারে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে, সেটির একদিকের অংশ ছোট ছোট বাঁশের লাঠিতে নাইলনের দড়ি বেঁধে ব্যারিকেড করে রেখেছে পুলিশ। সেই ব্যারিকেটের মধ্যে একটি পাথরের উপরে চাপচাপ রক্তের দাগ। পাথর থেকে রক্তের দাগ নেমেছে ডোবায় জলের দিকে। পুলিশের ধারণা, দেহটিকে টানতে টানতে ডোবার জলের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেই এই রকম দাগ হয়েছে। ডোবার একপাশে পড়ে রয়েছে এক জোড়া জুতো, এক পাশে বিকাশবাবুর বাবা মুকুন্দ দত্তের চশমা। শনিবার রাতে নিজেদের ধানজমির আল কাটার জন্য যে কুড়ুলটি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন বিকাশবাবু, সেটিও পড়ে রয়েছে ডোবার একদিকে। এ সবই খুঁটিয়ে দেখছিলেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সবরি রাজকুমার কে। তিনি জানালেন, এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে একাধিক ব্যক্তি জড়িত রয়েছে বলেই প্রাথমিক ভাবে তাঁদের অনুমান।

এ দিন এই গ্রামের সর্বজনীন দুর্গাপুজার প্রতিমা নিরঞ্জনের কথা ছিল। তার জন্য বিস্তর আয়োজনের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল বিকাশবাবুর নেতৃত্বে। তাঁর খুড়তুতো ভাই মলয় দত্ত বলেন, “গ্রামের পুজো পরিচালনার মূল দায়িত্ব থাকত দাদার উপরেই। তাকে নৃশংস ভাবে খুন হতে হয়েছে ভাসানের এক রাত আগেই। তাই গোটা গ্রাম শোকে থমথমে। সব শেষ হয়ে গেল।” ময়নাতদন্তের পরে এ দিন বিকেলে বিকাশবাবু ও তাঁর বাবার দেহ গ্রামে নিয়ে আসা হয়। সকাল থেকে শ্মশানে যে ভিড়টা ছিল, সন্ধ্যায় তা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

গ্রামের দুর্গা মণ্ডপ ঢেকে থেকেছে নিঝুম অন্ধকারেই।

ছবি: অভিজিত্‌ সিংহ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE