চাল পান?
পাই, তবে পোকায় কাটা চালের গুঁড়ো।
পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে?
নেই।
অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে রান্না করা খাবার মেলে?
না, মেলে না।
আর একশো দিনের কাজ?
দশ দিন কাজ পেলে, পরের দু’মাস এক দিনও জোটে না।
জলপাইগুড়ির বন্ধ রায়পুর চা বাগান এলাকায় গিয়ে রবিবার এমনই ‘নেই রাজ্যে’র হদিস পেলেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী। সম্প্রতি বন্ধ এই বাগানে অনাহারে, অপুষ্টিতে ৬ জনের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় যক্ষ্মায় ভুগে মারা যান জিতবাহান মুণ্ডা। আর তারপরই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। এ দিন এলাকায় যান খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এবং উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। শ্রমিকদের ক্ষোভের কথা শুনতে হয় তাঁদের। শ্রমিকেরা অভিযোগ করেন, অর্ধাহার-অপুষ্টিতে ভুগেই বন্ধ এই বাগানে গত অক্টোবর থেকে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তারপরেও অবশ্য অনাহারে মৃত্যুর কথা মানতে নারাজ খাদ্যমন্ত্রী। দু’দিন আগে বিধানসভা তিনি দাবি করেছিলেন, অনাহারে মৃত্যুর কোনও ঘটনা ঘটেনি।
এ দিনও সব দেখে-শুনে জ্যোতিপ্রিয় বলেন, “আবার বলছি, বিধানসভায় যা বলেছিলাম তা-ই ঠিক। অর্ধাহার বা অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা নেই। হৃদ্রোগ, অন্য রোগে শ্রমিকদের মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারের সদস্যরাই জানিয়েছেন। জেলা প্রশাসন সেই কারণ খুঁজছে।”
পশ্চিম মেদিনীপুরের আমলাশোলে অনাহারে মৃত্যুর পরেও তৎকালীন বাম সরকার একই ভাবে অনাহারের অভিযোগ নস্যাৎ করেছিল।
এ দিন খাদ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা সাংসদ অধীর চৌধুরী। দলের কর্মিসভায় যোগ দিতে এ দিন তিনি শিলিগুড়িতে ছিলেন। অধীরবাবু বলেন, “বাগানের শ্রমিকদের কঙ্কালসার চেহারা দেখুন। খেতে না পেয়ে তাঁরা মারা যাচ্ছেন কি না তা বিচার করুন।” কেন্দ্রের খাদ্য সুরক্ষা আইন এ রাজ্যে চালু হলে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটত না বলে মত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির। কংগ্রেসের এক প্রতিনিধি দল শীঘ্রই বাগানে আসবে বলেও জানান তিনি।
মুখে অনাহার-অপুষ্টির কথা অস্বীকার করলেও বিভিন্ন পরিষেবা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে শ্রমিকদের মুখে বারবার ‘নেই-নেই’ শুনে এ দিন দৃশ্যতই অস্বস্তিতে পড়ে যান দুই মন্ত্রী। অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন প্রশাসনিক আধিকারিকেরা এবং তৃণমূলের স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য প্রধান হেমব্রম। তবে শ্রমিকদের অনুরোধ সত্ত্বেও মন্ত্রীরা বাগানের ভিতরে ঢোকেননি। যাননি শ্রমিকবস্তিতে।
গত সাত দিনে মৃতদের পরিবারের সদস্যদের অফিসঘরে ডেকে তাঁদের হাতে অর্থ সাহায্য তুলে দেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতমবাবু। বাগানে ঘণ্টাখানেক থাকার পরে জলপাইগুড়ি সার্কিট হাউসে চলে যান দুই মন্ত্রী। সেখানেই জেলাশাসক, জেলা পুলিশ অফিসার, খাদ্য নিয়ামক-সহ প্রশাসনের বিভিন্ন আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক করেন। খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, আজ, সোমবার থেকে রায়পুর চা বাগানে বিশেষ শিবির করে, যাঁদের রেশন কার্ড নেই, তাঁদের কার্ড বিলি করা হবে। বন্ধ বাগানের জন্য বিশেষ পরিদর্শক নিয়োগ করে প্রতি সপ্তাহে কলকাতায় রিপোর্ট পাঠাতে বলা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আর এক মন্ত্রী গৌতমবাবুর আশ্বাস, “সহায় প্রকল্পে শ্রমিকদের রান্না করা খাদ্য সরবারহ করার ব্যবস্থা করা হবে, বেশি করে স্বাস্থ্য শিবির করা হবে। বাগান খোলার ব্যবস্থা করতেও প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
এ দিন দুপুর আড়াইটে নাগাদ দুই মন্ত্রী বন্ধ বাগানে পৌঁছন। বাগানের অফিস ঘরেই বসেন তাঁরা। সেখানে আসেন জনা পঞ্চাশেক শ্রমিক। তাঁরা রেশনে সরবারহ করা পোকায় কাটা চালের গুঁড়ো এনে মন্ত্রীদের দেখান। শ্রমিক শিউ তিরকে বলেন, “দেখুন স্যার যেটুকু চাল পাই, তারও এই দশা।’’ তখনই শ্রমিকরা জানান, কুয়োর জল পান করতে হয়, একশো দিনের প্রকল্পে নিয়মিত কাজ মেলে না, শ্রমিক আবাসনও জরাজীর্ণ।
বন্ধ বাগানের শ্রমিকেরা এ দিন ভেবেছিলেন, মন্ত্রীরা শ্রমিকবস্তিতে এসে দুর্দশার চিত্র দেখবেন। সে আশা পূরণ হয়নি। অফিসঘরে ডেকেই মৃতদের পরিজনদের অর্থসাহায্য দেওয়া হয়। সেই দলে ছিলেন মৃত জিতবাহানের বাবা ফাগু মুণ্ডাও। কবর খুঁড়ে জিতবাহানের দেহ সমাহিত করার টাকাও ছিল না পরিবারের। মন্ত্রীরা বাড়ির দোরগোড়ায় এসে ফিরে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ ফাগু। ছেলেহারা বৃদ্ধ বলেন, “সাহায্য পেলাম। তবে মন্ত্রীরা আমাদের বাড়ি ঘুরে দেখলে প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পারতেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy