সঙ্কট যখন ঘনীভূত, সেই সময়ে দলে গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য একটু দরজা ফাঁক করতে চাইছে সিপিএম!
সম্মেলন-পর্বে নতুন কমিটি নির্বাচনের সময় কোনও ভাবেই ভোটাভুটির দিকে যাওয়া যাবে না, এই কট্টর অবস্থান থেকে এ বার সরে আসছে তারা। আসন্ন সম্মেলনের জন্য জেলায় জেলায় যে রূপরেখা তৈরি করে পাঠিয়েছে সিপিএম, তাতে বলা হয়েছে: সর্বসম্মতির ভিত্তিতে নতুন কমিটির প্যানেল বেছে নেওয়ার চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু কোনও ভাবেই সর্বসম্মতি হচ্ছে না, এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে সম্মেলনে ভোটাভুটির মাধ্যমে নেতৃত্ব বেছে নেওয়া যেতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে যিনি বা যাঁরা নির্বাচিত হবেন, তাঁদেরই দলের সকলের প্রতিনিধি বলে মেনে নিতে হবে।
সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে মান্যতা দেওয়াই সিপিএমে বহু কালের নীতি। বস্তুত, যে কোনও দল বা সংস্থা পরিচালনায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বলতে তা-ই বোঝায়। ভোটাভুটি করে নতুন কমিটি বা নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার সংস্থান সিপিএমের গঠনতন্ত্রেও আছে। কিন্তু বাস্তবে এত দিন তার প্রয়োগ বিশেষ দেখা যায়নি! বরং, সম্মেলনে কোনও অবস্থাতেই ভোটাভুটি করা যাবে না, এই নীতিই মেনে চলার জন্য এত দিন জোর খাটাতেন সিপিএম নেতৃত্ব। এ বার উচ্চতর নেতৃত্বের প্যানেল পেশের রেওয়াজ রেখেও প্রয়োজনে ভোটাভুটির পথ বন্ধ করা হচ্ছে না। তফাত বলতে এখানেই।
দলের সঙ্গে জড়িত বা প্রাক্তন অনেক নেতাই সিপিএমের মনোভাবের এই পরিবর্তনকে বিলম্বে বোধোদয় হিসাবে দেখছেন। যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দল পরিচালনায় গণতন্ত্র দরকার, এই মতের পক্ষেই সওয়াল করে গিয়েছেন নয়ের দশকের শেষে সৈফুদ্দিন চৌধুরী থেকে সাম্প্রতিক কালে আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। সিপিএমে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে আসলে শুধুই নেতাদের মত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে সরব হয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন বহু ছোট-মাঝারি নেতা। দু’বছর আগে বহিষ্কৃত প্রসেনজিৎ বসুও একই অভিযোগ সামনে এনেছিলেন। আর তারও আগে সফি (সদ্যপ্রয়াত) বলতে চেয়েছিলেন, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে দলটা অংশ নিয়েছে, তার আর আদর্শগত ভাবে শ্রমিক শ্রেণির একনায়কতন্ত্রের লক্ষ্যের কথা বলা উচিত নয়। একই ভাবে দল চালানোর সময়েও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে উপর থেকে সব কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। দলেরই একাংশের অভিমত, এ বারের সম্মেলনে ভাবনার পরিবর্তনের যে ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে, সেটাই অনেক আগে হতে পারত এবং তা হলে এত লোককে হারাতেও হতো না!
সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যা, কঠিন সময়ে এখন যুগোপযোগী সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। নিষ্ক্রিয় এবং অপ্রয়োজনীয় লোকজন বাদ দিয়ে সব স্তরেই কমিটির কলেবর কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এই পথ ধরেই দলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশের দীর্ঘ দিনের দাবি মেনে ভোটাভুটির পথ খুলে রাখার কথা বলা হচ্ছে। পাছে কমিটি নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভে আরও বেশি লোকজন দল ছেড়ে যান, সেই আশঙ্কা থেকেই এমন ভাবনা বলেও দলের একাংশের মত। দলের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের কথায়, “শুধুই ভোটাভুটির কথা বললে সবাই নেতা হতে চাইতে পারেন। তাতে সম্মেলন-কক্ষে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা থাকে। এ বারও আলোচনা করে, সর্বসম্মতিতে কমিটি গড়াই প্রথম উদ্দেশ্য। কোথাও সমস্যা হলে তখন গণতান্ত্রিক ভাবে মতামত যাচাইয়ের কথা বলা হচ্ছে।”
কয়েক বছর আগে সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় সর্বসম্মতি হয়নি। জেলা কমিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত সুজন চক্রবর্তীর পক্ষে ছিল না। কিন্তু রেজ্জাককে আটকানোর জন্যই জেলা কমিটির সেই বৈঠকে হস্তক্ষেপ করে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু-সহ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর তিন সদস্য সুজনবাবুর পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। জেলা সিপিএমের অনেকেই এখনও বলেন, সুজনবাবুকে প্রায় জোর করেই সম্পাদক বাছতে হয়েছিল! সে দিনের বাধাপ্রাপ্ত রেজ্জাক অবশ্য এখন সিপিএমের ভাবনার পরিবর্তনকে বিশেষ অগ্রগতি হিসাবে দেখছেন না। রেজ্জাকের কথায়, “এখন ঠেকায় পড়ে এটা করছে! কিন্তু তাতেও সেই প্যানেল দেওয়ার ব্যবস্থাটা থাকছে। আমরা চেয়েছিলাম, আগে থেকে প্যানেল ঠিক করে দেওয়ার কিছু নেই। কত জনের কমিটি হবে, সংখ্যাটা বেঁধে দেওয়া হোক। তার পরে প্রতিনিধিরাই লিখিত ভাবে সেই সংখ্যক কমিটি বেছে নেবেন। সেটা তো হল না!”
কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, বেটার লেট দ্যান নেভার! তবে শেষ পর্যন্ত সম্মেলনগুলিতে কার্যক্ষেত্রে কত ভোটাভুটি করতে দেওয়া হচ্ছে, তা-ও দেখার কথা বলছেন অনেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy