আসন ফাঁকা। অথচ ভিতরে ঢুকতে চাইলে জুটেছে পুলিশের লাঠি, ঘোড়-পুলিশের তাড়া। নারী-শিশু নির্বিশেষে আহত, রক্তাক্ত বেশ কয়েক জন দর্শক!
মঙ্গলবার নাইট সংবর্ধনার ইডেনে এই পরস্পরবিরোধী ছবিটাই পুলিশ ও মন্ত্রী, উভয়পক্ষকেই অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, ভিতরে জায়গা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ লোক ঢোকাল না কেন?
ইডেন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহলের হিসেব অনুযায়ী, স্টেডিয়াম সংস্কারের পরে ওখানে মোট আসন এখন ৬৭ হাজারের কিছু বেশি। মঙ্গলবার শাহরুখ খান মাঠে ঢোকার পরে স্টেডিয়ামে লোক ছিল ৫৮ থেকে ৬০ হাজার। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বাইরে তখন অপেক্ষমান ছিল আরও হাজার পাঁচেক লোক।
যার অর্থ, সবাইকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিলেও মাঠে জায়গা থাকত!
পুলিশ অবশ্য দাবি করেছে, বাইরে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার লোকের ভিড় ছিল। পুলিশ-কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, ওই জনতার সকলকে মাঠে ঢুকতে দিলে স্টেডিয়ামের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারত এবং ভয়াবহতায় তা হয়তো ছাপিয়ে যেত ১৯৮০-র ১৬ অগস্টকে! যে দিন ইডেনে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে গণ্ডগোলের জেরে ১৬ জন ফুটবলপ্রেমী পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিলেন! “শাহরুখ ঢোকার সময় ইডেনের বাইরে হাইকোর্টের দিকে আর ক্লাব হাউসের দিকে কুড়ি-পঁচিশ হাজার করে মোট হাজার পঞ্চাশেক লোক ছিল! এ অবস্থায় গ্যালারির কিছুটা ফাঁকা থাকলেও আমাদের পক্ষে বেছে বেছে লোক ঢোকানো সম্ভব ছিল না।” বুধবার মন্তব্য করেন লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা।
পুলিশ মহলের অভিযোগ, দফায় দফায় অরূপ বিশ্বাস, ফিরহাদ হাকিম, মতো মন্ত্রীদের চাপে কিছু লোক ঢোকানোর ব্যবস্থা করতে হয়। তখনই বিশৃঙ্খলা, হুড়োহুড়ি, রক্তারক্তি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের সঙ্গে অবশ্য এই বক্তব্য পুরোটা মিলছে না। দর্শকদের একাংশের দাবি, মাঠে ঢুকতে মরিয়া জনতার সঙ্গে পুলিশের টানাপড়েন শুরু হয়েছিল সকাল সাড়ে ন’টা-দশটা থেকেই। তখন মন্ত্রীরা কেউ ছিলেন না। পরে বিকেলের দিকে ফিরহাদ যখন লোক ঢোকাতে বলেন, তখন হুড়োহুড়ি হয় ঠিকই। গার্ডরেল সরিয়ে দৌড়তে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ধাক্কাধাক্কি এবং পায়ের চাপে অনেকে জখম হন। কিন্তু পুলিশের লাঠিচার্জ, ঘোড়ার গুঁতোয় আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে গিয়েছিল দুপুরেই। তখন স্রেফ ভিড় সামলাতেই মারমুখী হয়েছিল পুলিশ।
ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছেন! মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনার বহর
আগাম বোঝা যায়নি। মাঠে এত লোক ধরানো সম্ভব ছিল না।
মদন মিত্র | ক্রীড়ামন্ত্রী
পশ্চিমবঙ্গ সরকার
মঙ্গলবারে বিশৃঙ্খলার পরে মন্ত্রী ফিরহাদ মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘একটা লোক পড়ে গিয়েছে, চারটে চটি পড়ে রয়েছে। সেগুলোকেই বড় করে প্রচার চলছে!’’ এ দিন কিন্তু তিনিই অভিযোগের তির পুলিশের দিকে ঘুরিয়ে প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছেন মঙ্গলবার যা ঘটেছে, তা নস্যাৎ করার মতো নয়! ফিরহাদের অভিযোগ, স্টেডিয়ামের বিভিন্ন গেট চেনাতে দর্শকদের জন্য কোনও নির্দেশিকা-বোর্ড না থাকাতেই সমস্যা হয়েছে। পুরমন্ত্রী এ দিন বলেন, “আইপিএল সেমিফাইনালের পরে বোর্ডগুলো খুলে ফেলা হয়েছিল। মঙ্গলবারের অনুষ্ঠানের আগে তা আর লাগানো হয়নি। হলে ভিড়টা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকত না। বিশৃঙ্খলাও কমত।” যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস অবশ্য কিছু বলতে চাননি। তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “আমি এ নিয়ে কিছুই বলব না।”
তবে মঙ্গলবারের ইডেনে ভিড়ের চরিত্রটা যে আইপিএল ম্যাচের টিকিটধারী দর্শকদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা ছিল, সেটা অবশ্য মন্ত্রী থেকে পুলিশ, সকলেই মেনে নিচ্ছেন। কী রকম?
লালবাজারের এক অফিসারের ব্যাখ্যা, আইপিএল ম্যাচ দেখতে যাঁরা টিকিট হাতে ঢোকেন, তাঁরা অনেক সুশৃঙ্খল। নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসেন। কিন্তু মঙ্গলবার যাঁরা শাহরুখদের বিজয়োৎসব দেখতে ঢুকছিলেন, তাঁরা সকলেই চাইছিলেন গ্যালারির নীচের অংশে বসতে। যাতে মাঠের কাণ্ডকারখানা কাছ থেকে চাক্ষুষ করা যায়। “ফলে একটা সময়ে লোক ঢোকানো বন্ধ করতেই হয়। নচেৎ মাঠের ভিতরে গাদাগাদি এড়াতে পুলিশকে লাঠি চালাতে হতো। আর মাঠে লাঠি চললে ১৯৮০-র ১৬ অগস্টের মতো বিপর্যয় ঘটাও অসম্ভব ছিল না।” আর এই যুক্তিতেই পুলিশ শেষমেশ মাঠের ভিতরে বেশি লোক ঢোকাতে চায়নি। এর মধ্যে শাহরুখের আসতে দেরি হওয়ায় পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে পড়ে।
কিন্তু পুলিশের এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, মাঠের ভিতরে দর্শকদের বসার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। নীচের দিকে লোক ভিড় করে বসেছে। উপরের আসনগুলিতে ওঠার পথও আটকে গিয়েছে। পুলিশ যদি ওই প্যাসেজ খালি করে দিতে পারত, তা হলে উপরের আসনগুলিতে বেশ কিছু লোকের বসার জায়গা হতো। ক্লাবহাউসের সামনে মঞ্চ বাঁধার ফলে পিছনের আসনগুলিতেও কেউ বসেনি। কারণ সেখান থেকে মঞ্চের অনুষ্ঠান দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বিকেলের দিকে সেই আসনগুলোতেও কিছু মানুষ বসার ব্যবস্থা করতে পারত পুলিশ। মঞ্চের অনুষ্ঠান দেখতে না পেলেও শাহরুখদের মাঠ প্রদক্ষিণ দেখার সুযোগ পেতেন তাঁরা।
বাইরে দাঁড়িয়ে পুলিশের তাড়া খাওয়ার চেয়ে সেটা সুবিধাজনক হতো তাঁদের পক্ষে।
ইডেনে বিশৃঙ্খলার প্রসঙ্গটি এ দিন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের কাছে তুলেছেন বামফ্রন্টের বিধায়কেরা। রাজ্যপালকে তাঁরাও বলেছেন, কেকেআর সংবর্ধনা ঘিরে মঙ্গলবার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রও এ দিন স্বীকার করেন, “ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছেন! মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনার বহর আগাম বোঝা যায়নি। মুখ্যমন্ত্রীকেও তো বলতে হয়েছে, এমন অনুষ্ঠান ব্রিগেড ছাড়া করা যাবে না!”
মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পাঁচটায় শাহরুখ ইডেন ছাড়া পর্যন্ত জনতার সঙ্গে নাগাড়ে যুঝতে পুলিশকে কার্যত হিমশিম খেতে হয়। আহত হন বেশ কয়েক জন পুলিশ কর্মীও। এ হেন অভিজ্ঞতার পরে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে ভবিষ্যতে এমন অনুষ্ঠান ব্রিগেডে করার ঘোষণা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচছেন পুলিশকর্তারা। তাঁরা বলছেন, “ব্রিগেডেও ভিড় নিয়ন্ত্রণে জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু ইডেনের মতো ঘেরা মাঠে অসংগঠিত ভিড় সামলানোর মতো অসাধ্য সাধন করতে হবে না।”
মন্ত্রী যখন সান্ত্রি। সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy