ফাঁকা মাঠ দেখে মঞ্চে না উঠে সাজঘরে ফিরে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল নেতা, সরকারি অফিসার আর পুলিশের উদ্যোগে শেষ পর্যম্ত ফাঁকা আসন কিছুটা ভরার পরে মিনিট কুড়ি পরে ফের গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে উত্তরবঙ্গ উৎসবের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের মঞ্চে ওঠেন তিনি।
আগের দু’বার এই উৎসবের অনুষ্ঠানে ছিল চোখে পড়ার মতো ভিড়। সেই অনুষ্ঠানগুলিও হয়েছিল শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে। এই স্টেডিয়ামে অন্তত ২৫ হাজার লোক ধরে। কিন্তু মঙ্গলবার তৃতীয় উত্তরবঙ্গ উৎসবের উদ্বোধন করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী দেখেন মঞ্চের সামনের চেয়ারগুলিও একরকম ফাঁকা, গ্যালারিতে ইতিউতি সামান্য ভিড়। মুখ্যমন্ত্রীকে মাঠে দেখে তখন উলুধ্বনি, শাঁখ বাজতে শুরু করেছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী আচমকাই দাঁড়িয়ে পড়েন। উদ্যোক্তাদের একাংশের হিসেবে, গোটা মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তখন হাজির বড় জোর ১৫০০ জন। তা দেখে মঞ্চের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন মুখ্যমন্ত্রী। পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করেন। মাঠে গুঞ্জন শোনা যায়, স্টেডিয়াম ফাঁকা দেখে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী ফিরে যাচ্ছেন।
রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র সহ সরকারি আধিকারিকরা তখন একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব মঞ্চ থেকে নেমে গেটের দিকে এগিয়ে যান। কিছু ক্ষণ পরে সকলেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। না, মুখ্যমন্ত্রী ফিরে যাননি। তিনি ভিড় কম দেখে স্টেডিয়ামে খেলোয়াড়দের সাজঘরে গিয়ে বসেছেন। তত ক্ষণে মাঠে ছড়িয়ে-ছটিয়ে থাকা স্কুল পড়ুয়াদের এককাট্টা করে স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে নামিয়ে মঞ্চের সামনে ফাঁকা চেয়ারে নিয়ে আসার কাজে নেমে পড়েছেন উদ্যোক্তাদের অনেকে। সরকারি অনুষ্ঠান বলে কথা। পুলিশের একদল অফিসার হইহই করে দর্শকদের ডেকে চেয়ারে বসান। ভিআইপি গেটের কড়াকড়ি উধাও হয়ে যায়। আম দর্শকদেরও মঞ্চের সামনে থাকা আমন্ত্রিত ও ভিআইপিদের চেয়ারে গিয়ে বসতে দেখে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, উৎসাহ দেয় পুলিশ।
কিন্তু তাতে স্টেডিয়ামের দু’টি গ্যালারি ফাঁকা হয়ে যায়। সেই ফাঁক ভরতে কিছু দর্শককে আবার ইশারায় গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে জেলার লোকসঙ্গীত শিল্পীদের নাম নথিভুক্তি করার কাজ চলছিল। লোকশিল্পীদেরও মঞ্চের সামনে ডেকে নিয়ে চেয়ারে বসানো হয়। স্টেডিয়ামের বিভিন্ন ব্লকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দর্শকদের সরিয়ে পুলিশকর্মীরা মঞ্চের সামনের তিনটি ব্লকে নিয়ে আসেন। অন্তত ২০ মিনিট ধরে চলে এই কাণ্ড। তারপরে মঞ্চের সামনে চেয়ার আর তেমন ফাঁকা নেই, এই খবর পৌঁছয় স্টেডিয়ামের সাজঘরে। মুখ্যমন্ত্রী সেখান থেকে বের হন। ফের শুরু হয় উলুধ্বনি। তবে এবার অবশ্য কিছুটা গম্ভীর মুখে মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে পৌঁছন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা চলাকালীন দু’টি গ্যালারিতে অনেকটাই ভিড় হয়।
বক্তৃতার সময়েও বাঁ দিকের স্টেডিয়ামের গ্যালারি প্রায় ফাঁকা। মুখ্যমন্ত্রী এবার ডান দিকে ফিরে মঞ্চের কোণায় চলে আসেন। সে দিকের স্টেডিয়ামের গ্যালারিও ফাঁকা। মুখ্যমন্ত্রী এবার মঞ্চের সামনে চলে এসে সোজাসুজি তাকিয়ে সামনের দর্শক ভর্তি ব্লকের দিকে তাকিয়ে বক্তৃতা শুরু করেন। বক্তৃতার মেয়াদ ছিল প্রায় ২২ মিনিট।
এ দিন উত্তরবঙ্গ উৎসব থেকে বিভিন্ন ক্লাব, মেধাবী পড়ুয়া, খেলোয়াড়দের সরকারি অনুদান বিলি করা হয়। কৃষকদের কিসান ক্রেডিট কার্ডের টাকা, কৃষি সরঞ্জাম সহ বিপিএল তালিকায় থাকা বাসিন্দাদের ইন্দিরা আবাস প্রকল্প, নিজ গৃহ নিজ ভূমি প্রকল্পের অনুদান-পাট্টা বিলিও করা হয়। সব মিলিয়ে অনুদান প্রাপকদের সংখ্যা হাজার খানেক। দার্জিলিং জেলার বিভিন্ন ব্লক এবং জেলা থেকে প্রশাসনের তরফেই বাস ভাড়া করে তাঁদের মাঠে নিয়ে আসা হয়। তাঁরা আত্মীয়দেরও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। মাঠ তাতে কিছুটা ভরে। ছিলেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শিল্পী এবং তাঁদের প্রশিক্ষক, পরিবারের সদস্যরাও। অনুদান পাওয়া বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যরা মাঠে এসেছিলেন ব্যানার নিয়ে।
কিন্তু মাসখানেক ধরে উত্তরবঙ্গ উৎসবের উদ্বোধনের আয়োজন করা হচ্ছে, তবু কেন গোড়ায় ভিড় জমল না?
অনুষ্ঠানের শেষে মন্ত্রী গৌতমবাবু অবশ্য বলেন, “অনুষ্ঠান শুরু ১টায়। তার আগে ভিড় কিছুটা কম ছিল। পরে বেশ ভিড় হয়েছে।” সরকারি সূত্রের খবর, উত্তরবঙ্গ উৎসবে দর্শক আনার জন্য অন্তত তিনশোটি বাস ভাড়া করা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা শুরুর পরে একে একে বাসগুলি পৌঁছয়।
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী দু’মাসের মধ্যে শিলিগুড়ি পুরসভা ভোট হওয়ার কথা। শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের বোর্ডেরও মেয়াদও গত বছর ফুরিয়েছে। সেখানেও দ্রুত ভোট করাতে হবে। সারদা কাণ্ডে মন্ত্রী-সাংসরা গ্রেফতার হওয়ায় এমনিতেই চিন্তা শাসক দল। তার উপরে দুই ভোটের আগে খোদ দলনেত্রীর অনুষ্ঠানের গোড়াতেই ফাঁকা স্টেডিয়াম ভাবিয়ে তুলেছে অনেককেই। বক্তৃতার শেষে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “উৎসবের আয়োজকদের ধন্যবাদ। গৌতম সহ টিমকে ধন্যবাদ।” যা শোনার পরে তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা কমিটির কয়েকজনের টিপ্পনি, “গোড়াতে সভাস্থল ফাঁকা দেখেই টিমওয়ার্কটা যে আসলে ঠিক নেই, সেটাই হয়তো বোঝালেন দিদি!”