Advertisement
১৭ মে ২০২৪

মারণ ঘরে কীসের গন্ধ, সংশয়ে পুলিশ

সুমন্তিকার মৃত্যু-রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য এখন গন্ধ বিচার করছেন তদন্তকারীরা। পুলিশ-সূত্রের খবর, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান এমএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় দমবন্ধ হয়েই মারা গিয়েছেন বলে তদন্তকারীরা মনে করছেন। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের অনুমানও তা-ই। কিন্তু কীসের জেরে তাঁর ‘দমবন্ধ’ হয়েছিল, তা নিয়ে সকলেই আপাতত অন্ধকারে।

বাড়িতে এল সুমন্তিকার দেহ। জলপাইগুড়িতে সন্দীপ পালের ছবি।

বাড়িতে এল সুমন্তিকার দেহ। জলপাইগুড়িতে সন্দীপ পালের ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৩
Share: Save:

সুমন্তিকার মৃত্যু-রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য এখন গন্ধ বিচার করছেন তদন্তকারীরা।

পুলিশ-সূত্রের খবর, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান এমএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় দমবন্ধ হয়েই মারা গিয়েছেন বলে তদন্তকারীরা মনে করছেন। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের অনুমানও তা-ই। কিন্তু কীসের জেরে তাঁর ‘দমবন্ধ’ হয়েছিল, তা নিয়ে সকলেই আপাতত অন্ধকারে।

রবিবার সকালে মধ্য কলকাতার আরপুলি লেনে ভাড়াবাড়ির ঘরে সুমন্তিকার দেহ পাওয়া যায়। জলপাইগুড়ির মেয়েটির ঘর-সঙ্গী, কার্শিয়াঙের মেয়ে সুবর্ণা লামাকে অসুস্থ অবস্থায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, দেহ উদ্ধারের সময় ঘরের ভিতরে উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধ ছিল। যা ছত্রিশ ঘণ্টা পরেও কাটেনি। গন্ধটা কীসের, এ দিন রাত পর্যন্ত পুলিশ তা বুঝে উঠতে পারেনি। এ দিন বিকেলে রাজ্য ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির চার বিশেষজ্ঞ ঘরটিতে ঢুকেছিলেন। ঘণ্টা তিনেক কাটিয়েও তাঁরা গন্ধটিকে নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিত করতে পারেননি। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে থাকা পুলিশ অফিসারদের অনেকে বলেছেন, “গন্ধের চোটে ঘরের ভিতরে একটানা থাকা যাচ্ছে না। দমবন্ধ হয়ে আসছে।”

ঘরের জানলার ধারে অপেক্ষারত সাংবাদিকদের নাকেও গন্ধ পৌঁছেছে। কীসের হতে পারে? কোনও আন্দাজ?

রবিবার দেহ উদ্ধারের পরে পুলিশের একাংশ মনে করেছিলেন, ঘরের ভিতরে কার্বন মনোক্সাইড জাতীয় গ্যাস থেকে থাকতে পারে। বদ্ধ ঘরে হাওয়া-বাতাস না খেললে এবং কিছু পুড়লে কার্বন ডাই-অক্সাইডের জায়গায় কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হয়। কার্বন মনোক্সাইড ফুসফুসের মাধ্যমে রক্তে ঢুকলে কার্বোক্সি হিমোগ্লোবিন নামে একটি বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে, যা কিনা রক্তের অক্সিজেন বহনক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। অক্সিজেনের অভাবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কাজ বন্ধ করে। এ ক্ষেত্রে দমবন্ধ হয়েও মৃত্যু ঘটতে পারে। তা হলে কি সুমন্তিকা কার্বন মনোক্সাইডের শিকার?

ফরেন্সিক এ দিন জানিয়েছে, গন্ধটা আর যা-ই হোক, কার্বন মনোক্সাইড গোত্রের নয় বলেই তাদের মনে হচ্ছে। বরং ওই ঝাঁঝালো গন্ধের সঙ্গে ক্লোরাইড বা নাইট্রেট জাতীয় যৌগের সম্পর্ক থাকতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু ক্লোরাইড বা নাইট্রেট ওখানে এল কোথা থেকে?

তদন্তকারীদের একাংশের বক্তব্য: কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় মাটির তলা দিয়ে গ্রেটার ক্যালকাটা গ্যাস সাপ্লাই কর্পোরেশনের পাইপলাইন রয়েছে। তা লিক করে গ্যাস বেরোতে পারে। সত্যিই বেরিয়েছে কি না যাচাই করতে আজ, মঙ্গলবার ওই নিগমের কর্তাদের ডাকা হয়েছে। কারও কারও আবার ধারণা, পুরনো সেপটিক ট্যাঙ্ক লিক করে গ্যাস বেরিয়েছে।

“পুরনো বাড়ির নির্দিষ্ট নক্শা থাকে না। হামেশাই দেখা যায়, ঘরের লাগোয়া সেপটিক ট্যাঙ্ক। তা লিক ঘরে ঝাঁঝালো বিষাক্ত গ্যাস ঢুকে পড়া অসম্ভব নয়।” বলছেন এক তদন্তকারী। আজ ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির রসায়ন বিশেষজ্ঞদের ঘটনাস্থল পরিদর্শনের কথা।

কিন্তু সুবর্ণা-সুমন্তিকা তো একই ঘরে ছিলেন! বিষাক্ত কোনও গ্যাসে যদি সুমন্তিকার দমবন্ধ হয়ে যায়, সুবর্ণা বেঁচে গেলেন কী করে?

পুলিশের কাছে এ-ও এক রহস্য। তদন্তকারীরা রবিবার সুবর্ণার সঙ্গে একপ্রস্থ কথা বলে জানতে পেরেছেন, শনিবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ দু’জনেই বাড়িওয়ালির বানিয়ে দেওয়া খাবার খেয়েছিলেন, অন্যান্য দিনের মতো। রুটি, কুমড়োর তরকারি, ডিমের ওমলেট। সুবর্ণার অবশ্য দাবি, সুমন্তিকা ওমলেট খেলেও তিনি খাননি। খেয়েদেয়ে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত দু’জনে গল্প করেন।

সুবর্ণা এ-ও জানিয়েছেন যে, শনিবার গভীর রাতে ও রবিবার সকালে তাঁর দু’বার ঘুম ভেঙেছিল। সকালে ঘুম ভাঙতেও তিনি বিছানা ছাড়লেন না কেন?

তদন্তকারীদের দাবি, এই প্রশ্নের উত্তরে সুবর্ণা জানিয়েছেন, শনিবার বিকেলে বাইরের কেনা চাউমিন খেয়ে তাঁর শরীর খারাপ লাগছিল। সুমন্তিকা তাঁকে একটি ওষুধ খেতে দেন। রবিবার সকালে ঘুম ভাঙলেও তিনি ঘোরের মধ্যে ছিলেন, বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা ছিল না। ফলে সুমন্তিকা কী অবস্থায় রয়েছেন, তা বুঝতে পারেননি।

হাসপাতাল-সূত্রের খবর, সুবর্ণা একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠছেন। অন্য দিকে তাঁর ‘রুমমেট’ সুমন্তিকার শেষকৃত্য এ দিন সম্পন্ন হয়েছে জলপাইগুড়িতে। বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদ সুমন্তিকার কফিনবন্দি দেহ যখন জলপাইগুড়ির পাহাড়িপাড়ার বাড়িতে আসে, পাড়া ছাপিয়ে ভিড় পৌঁছে গিয়েছে কদমতলা মোড়ে। শহরের মেধাবী মেয়েটিকে শেষ দেখা দেখতে কয়েক হাজার মানুষের ভিড়। সুমন্তিকার বাবা দেবাশিসবাবু এক বার জানতে চান, এত লোক কেন? তাঁর মেয়ের জন্যই সবাই অপেক্ষা করছে শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সুমন্তিকার মা শিপ্রাদেবীকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল।

রাতে শ্মশান থেকে ফিরে দেবাশিসবাবুও অসুস্থ হয়ে পড়েন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE