মঙ্গলবার সল্টলেক সিজিও কমপ্লেক্সের সামনে সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত নিয়ে পথনাটিকা বিজেপি সমর্থকদের। ছবি: শৌভিক দে
সিবিআইয়ের সমন পেয়েই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে ঠাঁই নিয়েছিলেন সরকারি হাসপাতালেও। কিন্তু কোথাওই চিকিৎসকেরা বারংবার পরীক্ষা করেও তাঁর শরীরের বড়সড় কোনও রোগের লক্ষণ পাননি। অগত্যা বাড়ি ফিরে সিবিআইকে জানিয়েছিলেন, এ বার তলব করলেই হাজির হবেন।
মঙ্গলবার দুপুরে সেই তলবি ফোনটি পেলেন রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার দুপুরে রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রীকে সরাসরি ফোন করেন সিবিআইয়ের এক অফিসার। তাঁকে বৃহস্পতিবার সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই দফতরে আসার জন্য বলা হয়েছে। সম্প্রতি আর এক কেন্দ্রীয় সংস্থা সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস-ও (এসএফআইও) সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে তাদের রিপোর্টে মদন মিত্রকে জেরা করার সুপারিশ করেছে।
সিবিআই মদনকে সারদা মামলার সাক্ষী হিসেবেই ডেকেছে। যেমনটি ডাকা হয়েছিল সাংসদ সৃঞ্জয় বসুকেও। তবে এ দিন শিয়ালদহ আদালত থেকে বেরোনোর সময় প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খান দাবি করেছেন, “মদন এখনই জেলে ঢুকবে। আমি বেরোলে, মুকুল ঢুকবে। তার পরেই মমতা।” ক’দিন আগেই অনেকটা বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের ঢংয়েই আসিফকে দাবি করতে শোনা গিয়েছিল চলতি মাসেই গ্রেফতার হবেন মদন, সামনের বছর মুকুল রায়। এ দিন সেই দাবিকেই আরও স্পষ্টতর চেহারা দিলেন আসিফ। জমি সংক্রান্ত প্রতারণার মামলায় বর্তমানে তিনি রাজ্য পুলিশের হাতে বন্দি।
আসিফের এই বিস্ফোরক বক্তব্যের দিনই সিবিআই মদনকে তলব করায় তৃণমূল যথেষ্ট অস্বস্তিতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে আসিফের উক্তি নিয়ে দলের এক শীর্ষনেতাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “মমতাকে এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়ানোর একটি রাজনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে। মমতার বিরুদ্ধে এ ধরনের কথাবার্তা হাস্যকর শুধু নয়, একটা বাচ্চাও এ সব বিশ্বাস করবে না।” তবে মুখ খুলতে চাননি মদন মিত্র বা মুকুল রায়। এমনকী সিবিআইয়ের তলব নিয়েও মদনবাবু কোনও মন্তব্য করতে চাননি। ঘনিষ্ঠ মহলে কোথাও কোথাও সিবিআই ফোন পাওয়ার কথাও অস্বীকার করেছেন।
এর আগে সিবিআই একবার লিখিত সমন পাঠিয়েছিল মদনবাবুর ভবানীপুরের বাড়িতে। ১৫ নভেম্বর সেই সমন পাওয়ার পরের দিন মন্ত্রী শহরের এক নার্সিংহোমে ভর্তি হন। সে দিন থেকে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত হয় নার্সিংহোমে, নয় হাসপাতালে প্রায় ৯১ রকম শারীরিক পরীক্ষা হয়েছে মদনবাবুর। মেডিক্যাল বোর্ডও বসেছিল। শেষে চিকিৎসকেরা জানান, ডায়াবেটিস, হৃদ-জনিত সমস্যা, ঘুম কম হওয়া ছাড়াও মন্ত্রীর প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, সিবিআইয়ের তলব পেয়েই ওই প্যানিক অ্যাটাক শুরু হয়। বেসরকারি ওই নার্সিংহোম থেকে ২১ তারিখ এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মদন। ২৬ নভেম্বর বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, মন্ত্রীর বিশ্রাম দরকার। কোনও ধরনের মানসিক চাপ তিনি সহ্য করতে পারবেন না। এ কারণে, বাড়ি ফিরে আসার পরেও তাঁর কাউন্সেলিং চলছিল।
এত সব দেখে চুপ করেই বসেছিল সিবিআই। মাঝে জিজ্ঞাসা করাতে তাঁরা বলেছিলেন, “উনি অসুস্থ। এখন ডাকা ঠিক হবে না।” এক বার কথা উঠেছিল, সিবিআই কি তবে হাসপাতালে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে? সেই সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়ে গোয়েন্দা অফিসার বলেছিলেন, “এত তাড়াহুড়োর কী আছে! ধীরেসুস্থে করলেই হবে।” সিবিআইয়ের আর এক কর্তার মন্তব্য, “আমরা ডাকার পরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আমরা হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছলে তো আরও ভয়ানক কিছু ঘটতে পারে!”
তবে সিবিআই সূত্রেরই খবর, গত কয়েক দিন ধরে মন্ত্রীর শারীরিক উন্নতির উপরে নজর রাখা হয়েছিল। চিকিৎসকরা কী রিপোর্ট দিয়েছেন, সে সম্পর্কে তদন্তকারীরা ওয়াকিবহাল। এক কর্তার কথায়, “তিনি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়েছেন। এখন কাজের মধ্যেও ফিরেছেন। দফতরের কাজ দেখভাল করছেন। দলীয় কর্মীদের নিয়ে বৈঠকও করছেন।” সুতরাং সিবিআইয়ের ধারণা, এ বার জিজ্ঞাসাবাদ মোকাবিলা করার মতো অবস্থায় আছেন মন্ত্রী। তাই তাঁকে ফের তলব করা হয়েছে।
সিবিআই জানাচ্ছে, মদনবাবু সারদার আর্থিক সংস্থার কর্মচারী সংগঠনের সম্পাদক ছিলেন। তিনি সারদার অনেক বিষয়েই ওয়াকিবহাল। অভিযোগ, সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল মন্ত্রীর। শুধু সুদীপ্তই নন, সারদার একাধিক কর্মচারীও মদনবাবুর সঙ্গে সারদা যোগাযোগের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। মদনবাবুর প্রাক্তন আপ্ত সহায়ক বাপি করিমকেও সিবিআই জেরা করেছে। জেরায় পাওয়া তথ্যই এ বার খোদ মদনবাবুর কাছ থেকে যাচাই করতে চান তদন্তকারীরা। জানা গিয়েছে, মদনবাবু সারদার মিডল্যান্ড পার্ক দফতরে আসতেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরে সারদা গার্ডেন্সেও যাতায়াত করতেন। অভিযোগ, যে সময়ে বিষ্ণুপুরে সারদার উত্থান সেই সময় সেখানকার বিধায়ক ছিলেন মদনই। এ ছাড়াও সারদার বহু অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকতেন। সিবিআইয়ের এক কর্তার কথায়, “আমরা মদনবাবুকে তদন্তে সহায়তার জন্য সাক্ষী হিসেবে সমন করেছি।”
আরও দ্রুত গতিতে কেন প্রভাবশালীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না, সেই দাবিতে এ দিনই অবশ্য সল্টলেকে সিবিআই দফতরের সামনে বিক্ষোভ দেখান রাজ্য বিজেপির কর্মীরা। প্রশ্ন উঠেছে, সিবিআই দফতরের সামনে কিছু দিন আগে সিপিএম বিক্ষোভ দেখাতে চাইলে পুলিশি অনুমোদন মেলেনি। দফতরের সামনে ১৪৪ ধারা জারি ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছিল। এ বার বিজেপিকে সেই জায়গাতেই কী ভাবে ধর্নার অনুমতি দেওয়া হল? বিধাননগর পুলিশ মহল থেকে কোনও সদুত্তর মেলেনি। তবে পুলিশের একটি সূত্রের খবর, সম্প্রতি ওই চত্বরে ১৪৪ ধারার মেয়াদ শেষ হয়েছে। নতুন করে আর মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। ফলে অনুমতি দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy