Advertisement
E-Paper

রাজনীতির রথী থেকে সাধারণ পথচারী, সবার মুখে অনুপ্রবেশ

বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মহকুমা শহর বসিরহাট। এখানে বড় তিনটি দলের প্রার্থীই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। শুনে তাজ্জব বনে গেলাম। এই কেন্দ্রে শতকরা ষাট ভাগ ভোটার নাকি সংখ্যালঘু। তাই এই ব্যবস্থা। ছবিতে কিন্তু কপালঠোকা সালাম নয়, জোড়হাতের ভঙ্গি। সিনায় সিনায় মোলাকাতও চোখে পড়ল না। এ রকমই তো হওয়ার কথা। দেশের সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতিই তো মনন-আচরণ গড়াপেটা করে তাবৎ জনগোষ্ঠীর।

শাহীন আখতার

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৪ ০৩:৪০

বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মহকুমা শহর বসিরহাট। এখানে বড় তিনটি দলের প্রার্থীই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। শুনে তাজ্জব বনে গেলাম। এই কেন্দ্রে শতকরা ষাট ভাগ ভোটার নাকি সংখ্যালঘু। তাই এই ব্যবস্থা।

ছবিতে কিন্তু কপালঠোকা সালাম নয়, জোড়হাতের ভঙ্গি। সিনায় সিনায় মোলাকাতও চোখে পড়ল না। এ রকমই তো হওয়ার কথা। দেশের সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতিই তো মনন-আচরণ গড়াপেটা করে তাবৎ জনগোষ্ঠীর। ও পারে মলিনা দাস তাই হুজুরের দোয়া-পড়া জল খাওয়ান জরাগ্রস্ত সন্তানকে। গায়ে বদ-হাওয়া লাগলে বা মূল্যবান কিছু চুরি গেলে ডাক পড়ে বাড়ির ধারের ইমাম সাহেবের। হিন্দু-মুসলমানের তরফে দরগায় মুরগি ছাড়া বা শিরনি চড়ানোর চল সেই আদ্যিকালের। এ পারেও সম্ভবত তা-ই।

গাছের ছায়াতলে জোড়াফুলের বহর সাজানো হচ্ছিল। মেঠো গল্পের টানে ধারেপিঠের এক চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ি। দোকানির ঠোঁটে কুলুপ। এটা-সেটা এগিয়ে দিতে দিতে তার গিন্নি বললেন, “পার্টি আমাদের কী দিয়েছে যে, র্যালিতে যাব?’’ হক কথা। আমারও সময় সময় ভাবতে ইচ্ছে করে, শাসক না থাকলে না জানি কেমন হতো আমাদের দেশটা! কান্ডারবিহীন নৌকোর মতো চলত না-হয় ঢেউয়ের দোলায়। চড়ায় গুঁতো খেত বা কুমোরের চাকের মতো ঘুরত ভোঁ ভোঁ করে। কিন্তু তা হলে তো ভোটের মজাটা মাটি হতো। নির্বাচন বরাবরই উৎসব বাংলাদেশের গাঁয়ে-গঞ্জে। এ বার বিরোধী দল সামিল না হওয়ায় অর্ধেক আনন্দই বরবাদ।

চায়ের দোকানির গিন্নির যত জ্বালা মেয়েদের নিয়ে। সেই কখন থেকে কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছে, “মা যাব, যাব মা?” মায়ের পাল্টা নালিশ, ক্লাস নাইন-টেনে পড়ে, র্যালিতে যেতে দেওয়া যায়!” দোকানের পিছন দিকে চুটিয়ে তাস খেলছে দু’জোড়া মানুষ। এক জন বৃদ্ধ কংগ্রেসি মুসলমান কাপে ফুঁ দিয়ে চা খাচ্ছিল। এখন তো নানামুখী হাওয়া বইছে। দল হারুক-জিতুক, তিনি হাতের পাঞ্জা তুলে বললেন, চিহ্ন বদলাবেন না। এমন জিদ্দি লোক, তায় আবার স্পষ্টভাষী। তাই এগিয়ে গিয়ে অনুপ্রবেশের কথাটা তুললাম, যা নিয়ে সম্প্রতি রথী-মহারথীরা নরক গুলজার করছেন। “এ সব বলেই তো আমাদের বিপদে ফেলা হচ্ছে।’’ চায়ের কাপ নামিয়ে বৃদ্ধ নড়েচড়ে বসলেন, “রেশন কার্ড করাতে গেলে এখন অনেক বেগ পেতে হয়। অনেক তথ্যপ্রমাণ দেখাতে হয়।”

আগের রাতে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। স্নিগ্ধ রোদ্দুরের চমৎকার হাওয়া। তার মধ্যে বসিরহাটের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে নানা দলের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। আনন্দবাজারের রিপোর্টার-ফটোগ্রাফার লাল ঝান্ডার গোটা তিনেক ম্যাটাডরের দিকে ছুটে গেলে, আমি আর জেএনইউ-এর ছাত্রী মৌসুমী মণ্ডল উৎসুক জনতার জটলার দিকে এগোই। মজা পুকুরের ধারে অসীমা সরকার আর শেফালি ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপ। না-পাওয়ার কিছু দুঃখ আছে অসীমার। বললেন, ‘‘১২ বছর হল, মা বিধবা হয়েছে। সে বিধবাভাতা পাওয়ার যোগ্য তো বলো!” পাশের এক জনকে দেখিয়ে বললেন, “এই কাকিমাও পায়নি।” ভাববাচ্যে কথা বলায় তুখোড় অসীমা। ভোটের গোপনীয়তা রক্ষায় ভঙ্গিটা হয়তো বেশ জুৎসই। শেফালির বাপের বাড়ি বাংলাদেশে। মামাবাড়ি বসিরহাটে, তাই এখানে এনে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে বহু দিন আগের কথা। এর মধ্যে বাবা মরেছে, মা মরেছে। পাসপোর্টের অভাবে তাদের দেখতে যেতে পারেননি। বলতে বলতে থেমে গেলেন শেফালি। শুষ্ক চোখে তাকিয়ে রইলেন মজা পুকুরের দিকে। তার কষ্টের তো ক্ষতিপূরণ নেই।

‘জাতীয় কংগ্রেস প্রার্থী, আপনার ঘরের সন্তান, আপনার কাছে আসছেন’। মাইকের আওয়াজটা কানে আসতেই রাস্তার পাশের একটি আধা-পাকা বাড়িতে ঢুকে পড়ি। চৌকাঠে মুখোমুখি কালো চশমা পরা বৃদ্ধের নাম গৌরহরি বাছার। গৌরহরিবাবু ২রা বৈশাখ চোখের ছানি কাটিয়েছেন সল্টলেকে। চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা। ‘‘আপনি কী করেন?’’ কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে এক জন। গৌরহরি বাবু যা করেন, তা-ই সরলচিত্তে পেশ করলেন। ‘‘খবরদার জোড়াফুলে ভোট দেবেন না। বিজেপিকে দেবেন।’’ খবরটা গৌরহরি বাছারের অন্ধ চোখে আকাশবাণীর মতো শোনায়। মনে ভাবনা, এ কেমন বিভেদের কথা!

বসিরহাট-সাতক্ষীরার সীমান্ত ফাঁড়ির নাম ও দিকে ভোমরা, এ দিকে ঘোজাডাঙ্গা। ফলন্ত আম, জামরুলের শোভা দেখতে দেখতে যাচ্ছি। মনে খানিক পুলক, খানিক ভয়। বর্ডার মানেই লোমহর্ষক, রোমাঞ্চকর কিছু। জাদু-বাস্তবতার আকর। পাশ দিয়ে ধুলো-ওড়ানো লরি ছুটে গেলে মনে হয় এ কি তেরপল-ঢাকা এমন কোনও বোঝাই, যার মধ্যে রত্ন লুকোনো? মার্কেজের ‘এরেন্দিরা’ গল্পের মতন? বা এমন কোনও কষ্টিপাথর আছে কি, প্রেমিকের হাতের ছোঁয়ায় যার রং পাল্টে যায়! প্রাণ-সংহারী উড়ন্ত বুলেটও ছুটে আসে যখন-তখন। কাঁটাতারে ঝুলন্ত ফেলানি যার প্রতীক হয়ে আছে বাংলাদেশে।

ঘোজাডাঙ্গা খালের ধারে বিএসএফ আটকালে, একটি লোকের সঙ্গে আলাপ হল। যেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা মানুষটি পরিচয় দিলেন, গাড়ির খালাসি। মালবোঝাই লরির সঙ্গে এপার-ওপার করেন। এখন শরীর খারাপ। লিভার টনিক হাতে বাড়ি ফিরছেন। বললেন, “মাঝে একটা অশান্তি হয়েলো, কোপাইলো আমারে।’’

‘‘কে?’’

‘‘সে আমি চিনতে পারিনি দিদি”, বলে ঝুঁকে পড়ে দোমড়ানো গাল-চিবুক দেখালেন খালাসি। বললেন, পাত লাগানো আছে। লিকুইড খেতে হয়। বাড়ির ওপর দিয়ে মাল পাচার হয়। এখন যেমন, তখনও কাউকে কিছু বলেননি খালাসি। তা-ও কোপালো। উঠোনের জলের কলটাও রাতের অন্ধকারে ভেঙে দিয়ে গেছে। এ তো মস্ত বড় ধাঁধা! এ রহস্য বোঝা আমাদের মতো চুনোপুঁটির জন্য দুরাশা।

ফিরে আসি খালের উপরে ব্রিজের গোড়ায়। যেখানে বিএসএফ কাগজপত্র পরখ করছে। সীমান্ত এখান থেকে বেশ খানিকটা দূর। তবু পাহারায় এত আঁটাআাঁটি। ওখানে দাঁড়িয়ে খুচরো আলাপ হচ্ছিল পথচারীদের সঙ্গে। ‘অনুপ্রবেশ’ শব্দটা সবার মুখে মুখে। জানা গেল, ক’মাস আগে কিছু লোক এসেছিল এ পারে। শেখ হাসিনার নির্বাচনটা যখন হয়। তারা সবাই হিন্দু। শান্তি আসাতে যে যার ঘরে ফিরে গেছে। সে সময় গুঞ্জন উঠল, লরি বোঝাই ফেনসিডিল, জিরে-মরিচ যাচ্ছে ও পারে। জিরে-মরিচ হয়তো ভারতের রফতানিজাত পণ্য। ফেনসিডিল তো চোরাই মাল, যার দাপট ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এ শুধু সর্দি-কাশির দাওয়াই নয়। এর মৌতাতে উচ্ছন্নে যাচ্ছে বাংলাদেশের ধনী-গরিব নির্বিশেষে তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ।

দিনটা যে ভাবে শুরু হয়েছিল, মধ্যাহ্নে অন্য চেহারা। বাতাস গরম, পরিবেশ উত্তপ্ত। কলকাতা ফেরার পথে বিদ্যাধরীর ও পাশে মালঞ্চ বাজার। হাতুড়ি-ধানের শিষে সভার তোড়জোড় চলছে। মাইকে ঘোষণা, বিরতিতে গান। বক্তৃতা শুরু হয়নি। দূর পথ হেঁটে এক প্রৌঢ় ছাতা গুটিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকলেন। চা খেলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে খুচরো পয়সা দিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেলেন লালঝান্ডার সমাবেশে।

মাইকে চিন্ময়ের গলায় গান বাজছে, নয় নয় নয় এ মধুর খেলা।

shahin akhtar infiltration
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy