Advertisement
২০ মে ২০২৪

শিবুর প্রতারণার শিকার সুদীপ্তও, বলছে সিবিআই

এ যেন চোরের ওপর বাটপাড়ি! রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ বিশ্বাস করে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন কষ্টে জমানো টাকা। অভিযোগ, সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন সেই টাকা আত্মসাৎ করার জন্য তৈরি করেছিলেন প্রতারণার নানা পরিকল্পনা। আবার এই কাজে তাঁর প্রধান ভরসার লোক শিবনারায়ণ দাসই তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন এই অভিযোগ খোদ সুদীপ্ত সেনের।

অর্থ লগ্নি সংস্থায় প্রতারিতদের মিছিল। কলেজ স্কোয়ার থেকে রানি রাসমণি রোড পর্যন্ত এই মিছিলে হাঁটলেন বাম নেতা সুজন চক্রবর্তী ও মনোজ ভট্টাচার্য।—নিজস্ব চিত্র।

অর্থ লগ্নি সংস্থায় প্রতারিতদের মিছিল। কলেজ স্কোয়ার থেকে রানি রাসমণি রোড পর্যন্ত এই মিছিলে হাঁটলেন বাম নেতা সুজন চক্রবর্তী ও মনোজ ভট্টাচার্য।—নিজস্ব চিত্র।

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৬
Share: Save:

এ যেন চোরের ওপর বাটপাড়ি!

রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ বিশ্বাস করে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন কষ্টে জমানো টাকা। অভিযোগ, সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন সেই টাকা আত্মসাৎ করার জন্য তৈরি করেছিলেন প্রতারণার নানা পরিকল্পনা। আবার এই কাজে তাঁর প্রধান ভরসার লোক শিবনারায়ণ দাসই তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন এই অভিযোগ খোদ সুদীপ্ত সেনের।

শিবনারায়ণের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের কাছে এই বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি সবিস্তারে বলেছেন সারদা কর্তা। সিবিআইয়ের এক তদন্তকারীর কথায়, শিবনারায়ণকে গ্রেফতার করার জন্য একাধিক বার তদন্তকারীদের অনুরোধও করেন সুদীপ্তবাবু। সিবিআইয়ের কাছে সুদীপ্তের অভিযোগ, তাঁর অর্থলগ্নি সংস্থার কয়েকশো কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন শিবু। সুদীপ্তের দাবি, এই কারণেই কলকাতা ছেড়ে পালানোর আগে সিবিআইকে লেখা চিঠিতেও শিবনারায়ণের নাম লিখে গিয়েছিলেন তিনি।

সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, সারদার টাকায় নিজের অর্থলগ্নি সংস্থার প্রাথমিক পুঁজি তৈরি করেছিলেন শিবনারায়ণ। এ কথা জেরাতে কবুল করেছেন শিবনারায়ণও। কিন্তু কত টাকা তিনি সারদা থেকে নিয়েছিলেন, সে বিষয়ে সঠিক কোনও তথ্য এখনও তিনি দেননি। ওই বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন তদন্তকারীরা।

সিবিআইয়ের এক পদস্থ অফিসার জানিয়েছেন, “আমরা সুদীপ্তের বয়ান অনুযায়ী তদন্ত শুরু করেছিলাম। সারদার একাধিক কমর্চারী, গাড়ির চালক, হিসেবরক্ষক ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়কে দফায় দফায় শিবনারায়ণের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। দেবযানী সারদার ব্যাঙ্ক আমানতের বিষয়টি দেখাশোনা করতেন।” তদন্তকারীদের দাবি, আমানতকারীদের কাছ থেকে কত টাকা তোলা হয়েছিল এবং ওই টাকা কী ভাবে খরচ করা হয়েছে, তা দেবযানীর নখদর্পণে রয়েছে। সিবিআই কর্তাদের দাবি, শিবনারায়ণ সারদার টাকা কী ভাবে আত্মসাৎ করেছেন, তা দেবযানীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে সবিস্তার জানা গিয়েছে।

শিবনারায়ণ কী ভাবে সুদীপ্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন?

সুদীপ্তের বয়ান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে অর্থলগ্নি ব্যবসার শুরুর সময় তাঁর দুই গাড়ির চালক শিবনারায়ণের বিষয়ে তাঁকে খবর দেন। ওই চালকদের মাধ্যমেই হাওড়ার শিবনারায়ণের সঙ্গে সুদীপ্তের পরিচয় হয়। এর আগে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল শিবনারায়ণের। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর জন্য সুদীপ্ত তাঁকে নিজের সংস্থায় নিয়ে আসেন। ধীরে ধীরে সারদার অর্থলগ্নি সংস্থার মাথা হয়ে ওঠেন শিবনারায়ণ। মূলত শিবনারায়ণের হাত ধরেই ২০০৯ সালের পর থেকে সারদার অর্থলগ্নি ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে বলে সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা জেনেছেন। এ ভাবেই ধীরে ধীরে সুদীপ্তের বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন শিবু। সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, সারদার কাছ থেকে মাসে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা বেতন নিতেন তিনি।

এখান থেকেই কাহিনিতে আসে নতুন মোড়। অভিযোগ, সাধারণ মানুষের বিশ্বাস নিয়ে প্রতারণার খেলায় নেমে সুদীপ্ত সেন নিজেই প্রতারণার পাল্লায় পড়েন। সুদীপ্তের বয়ান ও সিবিআইয়ের তদন্ত অনুযায়ী জানা গিয়েছে, সারদার কাজ করার পাশাপাশি শিবনারায়ণ গোপনে শুরু করে দিয়েছিলেন নিজের অর্থলগ্নি সংস্থা ‘সিলিকন’। এক তদন্তকারীর কথায়, সারদায় নিজের বিশ্বস্ত এজেন্ট ও কর্মীদের নিয়ে একেবারে সারদা ‘স্টাইল’-এ কাজ শুরু করে সিলিকন। সারদা থেকে কোটি কোটি টাকা সরিয়ে ফেলা হয় এই সংস্থায়। নিজের বিশ্বাসভাজনের এই কীর্তির কথা অবশ্য ঘুণাক্ষরেও টের পাননি সুদীপ্ত। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ২০১০ সালের জুলাই মাসের পর থেকে সারদার বিভিন্ন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে বেনামের কিছু অ্যাকাউন্টে টাকা সরিয়ে দেওয়ার জন্য হিসেবরক্ষকদের নির্দেশ দিতে শুরু করেন শিবনারায়ণ। কখনও কখনও নানা খরচের হিসেব দেখিয়ে সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিস থেকে নগদ টাকাও নেওয়া শুরু করেন তিনি। ২০১০-এর জুলাই থেকে ২০১১-র এপ্রিল মাসের মধ্যে শিবনারায়ণ সারদার প্রায় তিনশো কোটি টাকা সরিয়ে ফেলেছিলেন বলে সিবিআইয়ের কাছে অভিযোগ করেছেন সুদীপ্ত। তদন্তকারীদের তিনি জানিয়েছেন, তিনি যখন বিষয়টি বুঝতে পারলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।

সুদীপ্তের বয়ান অনুযায়ী, শিবনারায়ণের বিষয়ে দেবযানীই প্রথম তাঁকে সতর্ক করেন। এ ব্যাপারে দেবযানীর বয়ানও নেন তদন্তকারীরা। সিবিআই সূত্রে খবর, শিবনারায়ণ সারদা থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকা দিয়ে এক দৈনিক পত্রিকাও চালু করে দেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তৃণমূলের কয়েক জন প্রভাবশালী নেতা। পত্রিকার মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে আরও কয়েক জন প্রভাবশালী নেতার।

এই সময় শিবনারায়ণ এতটাই ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন যে ২০১১ সালে তাঁকে সারদার ডিরেক্টর পদ থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েও পারেননি সুদীপ্ত। সিবিআইয়ের কাছে সুদীপ্ত ও দেবযানী পৃথক ভাবে জানিয়েছেন, ওই নেতাদের চাপে শিবনারায়ণের বিরুদ্ধে কোনও আইনি পদক্ষেপও করা যায়নি। তবে ওই সময়ে, অর্থাৎ ২০১১ সালে শিবনারায়ণ নিজেই সারদা থেকে ইস্তফা দেন। এর পর তিনি নিজের সংস্থার কাজেই পুরোপুরি ঢুকে পড়েন।

সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, শিবনারায়ণের মদতদাতা কয়েক জন তৃণমূল নেতার নামও তদন্তকারীদের জানিয়েছিলেন সুদীপ্ত। ঘটনার তদন্তে নেমে শাসক দলের ওই নেতাদের সঙ্গে শিবনারায়ণের যোগাযোগের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে বলে দাবি করছেন সিবিআইয়ের কর্তারা। তাঁদের দাবি, রাজ্যের এক মন্ত্রী ও শাসক দলের বেশ কয়েক জন নেতার সঙ্গে শিবনারায়ণের ঘনিষ্ঠতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ধৃত শিবনারায়ণকে জেরা করেও ওই সব নেতাদের ব্যাপারে অনেক তথ্য মিলেছে বলে তদন্তকারীদের দাবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

saradha scam cbi sudipta sen shibnarayan das
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE