Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সংখ্যালঘু উন্নয়নের ফানুস ফুটো নবান্নেরই রিপোর্টে

মন্ত্রী যা দাবি করেছেন, সরকারই তার উল্টো গাইল! তিনি আবার যে সে মন্ত্রী নন, খোদ মুখ্যমন্ত্রী! মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের ভার। এবং মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলেছেন, ক্ষমতায় আসার ছ’মাসের মধ্যেই তাঁর সরকার সংখ্যালঘু উন্নয়নের নব্বই ভাগ কাজ সেরে ফেলেছে! যদিও সে দাবির বাস্তবতা নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন নেতা বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

সায়নী ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩১
Share: Save:

মন্ত্রী যা দাবি করেছেন, সরকারই তার উল্টো গাইল! তিনি আবার যে সে মন্ত্রী নন, খোদ মুখ্যমন্ত্রী!

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের ভার। এবং মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলেছেন, ক্ষমতায় আসার ছ’মাসের মধ্যেই তাঁর সরকার সংখ্যালঘু উন্নয়নের নব্বই ভাগ কাজ সেরে ফেলেছে! যদিও সে দাবির বাস্তবতা নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন নেতা বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকী, বছর দুয়েক আগে রেড রোডে নমাজপাঠের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে এই হেন দাবি শুনে মঞ্চ থেকেই কড়া কথা শোনাতে ছাড়েননি বক্তারা। সম্প্রতি সংখ্যালঘুদের এক অনুষ্ঠানেও মমতার দাবির প্রসঙ্গ তুলে সরকারের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।

এ বার মুখ্যমন্ত্রীর দাবিকে কার্যত নস্যাৎ করে দিয়েছে দিল্লিকে দেওয়া নবান্নেরই তথ্য। কেন্দ্রের দেওয়া সংখ্যালঘু উন্নয়নের টাকায় দেশের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোয় গত তিন বছরে কেমন কাজকর্ম হয়েছে, তা যাচাই করতে গত সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রক বৈঠক ডেকেছিল। দেখা যাচ্ছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিদের পেশ করা তথ্যের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর দাবির আসমান-জমিন ফারাক। কী রকম?

সরকারি সূত্রের খবর: দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০১২-১৩য় শুরু) সংখ্যালঘু উন্নয়নে ‘মাল্টি সেক্টরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’ (এমএসডিপি) খাতে পশ্চিমবঙ্গে আপাতত ৯২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ, যার ৪৯৭ কোটি রাজ্য ইতিমধ্যে হাতে পেয়ে গিয়েছে। এই অর্থে সংখ্যালঘুদের জন্য ইন্দিরা আবাস যোজনার বাড়ি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, শৌচালয়, পানীয় জল প্রকল্প, আইটিআই, পলিটেকনিক, হস্টেল, রাস্তা ইত্যাদি হওয়ার কথা। রাজ্য সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত তিন বছরে কেন্দ্রের পাঠানো টাকার মধ্যে রাজ্য সরকার খরচ করে উঠতে পেরেছে সাকুল্যে ৫৮%! যা মুখ্যমন্ত্রীর দাবির (নব্বই ভাগ) থেকে অনেক কম।

কেন্দ্রীয় নানা প্রকল্পে অনেক ক্ষেত্রে রাজ্যের তরফেও অর্থ বরাদ্দের (ম্যাচিং গ্রান্ট) নিয়ম থাকে। কিন্তু এমএসডিপি’তে তা প্রযোজ্য নয়। এর পুরো খরচই কেন্দ্রীয় সরকার বহন করে। অর্থাৎ, রাজ্যের আর্থিক সঙ্কটের দরুণ ম্যাচিং গ্রান্ট দেওয়া যাচ্ছে না এই যুক্তিও এখানে খাটে না। রাজ্যের দায়িত্ব শুধু প্রকল্প রূপায়ণ। অর্থের সংস্থান থাকা সত্ত্বেও ওই দায়িত্ব পালনে এ হেন ‘ব্যর্থতা’ আসলে প্রশাসনের অন্দরে সমন্বয়ের অভাবকেই প্রকট করেছে বলে আধিকারিকদের একাংশ মনে করছেন। সেই আধিকারিকদের বক্তব্য, এই ধরনের কাজে একসঙ্গে এত দ্রুত এই পরিমাণ টাকা হাতে পাওয়ার অভ্যাস নেই রাজ্যের দফতরগুলির। হতে পারে, সে জন্যই নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারেনি তারা। সরকারি তরফে ঢিলেমি তো রয়েইছে। সব মিলিয়ে সমন্বয়ের অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।

ফল যা হওয়ার, সেটাই হয়েছে। নবান্নের দেওয়া খতিয়ান জানাচ্ছে, এমএসডিপি’র আওতায় সংখ্যালঘু দফতর সব মিলিয়ে প্রায় ৪২ হাজার প্রকল্প বা স্কিম হাতে নিয়েছিল। তিন বছর পার করে বড়জোর চার হাজারটি শেষ করা গিয়েছে। ২২ হাজারটির কাজ চলছে। প্রায় ১৬ হাজার প্রকল্পে এখনও হাতই পড়েনি! বহু জায়গায় কাজের গতি অত্যন্ত শ্লথ। প্রস্তাবিত আইটিআই বা পলিটেকনিকগুলোর জন্য তো একটা ইটও গাঁথা হয়নি! কর্মী প্রশিক্ষণ ও রাস্তা নির্মাণেও যারপরনাই ঢিলেমি।

শুধু দীর্ঘসূত্রিতাই নয়, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জমি পাওয়া নিয়ে সমস্যা। স্কুল, আইটিআই বা পলিটেকনিক তো বড় বিষয়, অনেক সময় স্কুলবাড়ির ঘর বাড়ানোর জন্যও জায়গা পেতে কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে, জানাচ্ছে প্রশাসনের একটি অংশই। এই সরকারের জমি নীতিই যে এর জন্য দায়ী, সে কথাও জানাচ্ছেন তাঁরা।

অর্থাৎ, সব মিলিয়ে রাজ্যে এমএসডিপি’র কাজের অগ্রগতির ছবিটা যথেষ্ট নিরাশাব্যঞ্জক।

এমতাবস্থায় চলতি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বাকি দু’বছরে বকেয়া সব কাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে দফতরের অন্দরে ঘোরতর সংশয়। সে ক্ষেত্রে টাকা ফেরত চলে যাওয়ারও সমূহ সম্ভাবনা। রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী গিয়াসুদ্দিন মোল্লা বলছেন, “কাজ নিজের গতিতে এগোচ্ছে। কোথাও তাড়াতাড়ি হচ্ছে, কোথাও ধীরে। কোথাও জায়গা নিয়ে সমস্যা, কোথাও ইঞ্জিনিয়ারের অভাবে কাজ উঠছে না। কোথাও আবার সরকারি কর্মীর সংখ্যা কম।” প্রস্তাবিত সব প্রকল্প সামনের দু’বছরে শেষ হবেকি না জানতে চাইলে তাঁর জবাব, “বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে বৈঠক হচ্ছে। দেখা হচ্ছে, কোন কাজ কোন সমস্যার ফলে আটকে রয়েছে।” কিন্তু এত দিন ধরে মুখ্যমন্ত্রী যা দাবি করে আসছেন, তার কী হল?

“মুখ্যমন্ত্রীর দাবি ঠিক,” সংক্ষিপ্ত মন্তব্য প্রতিমন্ত্রীর। দফতরের সচিব সইদুল ইসলামের বক্তব্য, “কেন্দ্রের অনুমোদিত অধিকাংশ টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে।” সেপ্টেম্বরের ওই রিপোর্টে উল্লিখিত তথ্য প্রসঙ্গে সচিবের ব্যাখ্যা, “কাজ চলছে, পরিসংখ্যানও বদলাচ্ছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান না-জেনে কিছু বলা যাবে না।”

বিরোধীরা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর দাবির বিরোধিতায় গোড়া থেকে সরব। সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের অভিযোগ, “২০০১-এ সংখ্যালঘু উন্নয়নের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ছিল দেশে পয়লা নম্বরে। এখন তলানিতে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে দফতরের মন্ত্রী। তিনি ঘুরছেন, সব দেখছেন। কিন্তু কাজের কাজ যে কিছু হচ্ছে না, সে দিকে ওঁর নজর নেই!” সেলিমের আশঙ্কা, ভাল কাজ দেখাতে না-পারলে পরের বছর রাজ্য টাকাও কম পাবে। কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়ার প্রতিক্রিয়া, “পিছিয়ে পড়া এলাকা উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রের যে বিআরজিএফ প্রকল্প, তার প্রথম পর্বে টাকা খরচের হিসেব রাজ্য সরকার আজ পর্যন্ত কেন্দ্রকে দিতে পারেনি। এমএসডিপি’রও এক হাল।” এ জন্য জমির সমস্যা ও দফতরের বিভিন্ন স্তরে সমন্বয়ের ঘাটতির দিকে আঙুল তুলেছেন মানসবাবু। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণ, “সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পরে জমি অধিগ্রহণ এ রাজ্যে মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জমি না-থাকলে উন্নয়ন হবে না। সদিচ্ছা না-থাকলে কোনও কাজই করা সম্ভব নয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

minorities nabanna sayani bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE