Advertisement
০৬ মে ২০২৪
মুখরক্ষা ডিভিশন বেঞ্চে

স্থগিত পাড়ুই মামলা, বদলাল এজলাস

পাড়ুইয়ের সাগর ঘোষ খুনের মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত অনুব্রত মণ্ডলকে কেন এখনও গ্রেফতার করা গেল না, রাজ্য পুলিশের ডিজি-র মুখ থেকে সরাসরি শুনতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত সে সুযোগ পেলেন না। শুক্রবার আদালতের কাজ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্য সরকার বিচারপতি দত্তের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে আবেদন করল প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে। ডিভিশন বেঞ্চ ডিজি-র হাজিরা নিয়ে শুধু তিন সপ্তাহের স্থগিতাদেশই দিল না। উপরন্তু জানিয়ে দিল, তিন সপ্তাহ পরে পাড়ুই মামলার শুনানি বিচারপতি দত্তের এজলাসে আর হবে না। মামলাটি শুনবে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৫৪
Share: Save:

পাড়ুইয়ের সাগর ঘোষ খুনের মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত অনুব্রত মণ্ডলকে কেন এখনও গ্রেফতার করা গেল না, রাজ্য পুলিশের ডিজি-র মুখ থেকে সরাসরি শুনতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত সে সুযোগ পেলেন না।

শুক্রবার আদালতের কাজ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্য সরকার বিচারপতি দত্তের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে আবেদন করল প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে। ডিভিশন বেঞ্চ ডিজি-র হাজিরা নিয়ে শুধু তিন সপ্তাহের স্থগিতাদেশই দিল না। উপরন্তু জানিয়ে দিল, তিন সপ্তাহ পরে পাড়ুই মামলার শুনানি বিচারপতি দত্তের এজলাসে আর হবে না। মামলাটি শুনবে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চই।

সবিস্তার...

এ দিনের এই নির্দেশের জেরে বীরভূম জেলার তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেফতারি প্রসঙ্গটি আপাতত ধামাচাপা পড়ে গেল বলেই মনে করছেন আইনজ্ঞরা। পাশাপাশি আদালতে রাজ্য পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তার হেনস্থার আশঙ্কাও কাটল ।

গত বছর ২১ জুলাই পাড়ুইয়ে খুন হন সাগর ঘোষ। সেই মামলার শুনানি এত দিন বিচারপতি দত্তের এজলাসেই চলছিল। তদন্তে অগ্রগতি হয়নি দেখে ১৪ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তভার তিনিই ডিজি-র নেতৃত্বাধীন বিশেষ তদন্তকারী দলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মঙ্গলবার বর্ধমানের একটি নির্বাচনী সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দেখা গিয়েছিল অনুব্রতকে। সেই প্রসঙ্গ তুলে বৃহস্পতিবার বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর ‘আশীর্বাদ-ধন্য’ হলে ওই নেতাকে পুলিশ গ্রেফতার করবে কী করে!

একাধারে মুখ্যমন্ত্রী এবং ডিজি, দু’জনের প্রতিই সে দিন কড়া বার্তা দিয়েছিলেন বিচারপতি। ‘ডিজি কি আদালতের ধৈর্য পরীক্ষা করছেন’ বলে তির্যক প্রশ্ন ছুড়ে বিচারপতি বলেছিলেন, সাংবিধানিক পদমর্যাদার খাতিরে মুখ্যমন্ত্রী এবং বিচারপতির মধ্যে পারস্পরিক সম্মান থাকা উচিত। প্রকাশ্য সভামঞ্চে হাজির থাকা সত্ত্বেও কেন অনুব্রতকে ধরা হচ্ছে না, সে কথা সরাসরি জানতেই ডিজি-কে ডেকে পাঠান তিনি। ডিজি-র পছন্দমতো সময়েই তাঁকে এজলাসে হাজির হতে বলা হয়েছিল। সেই মোতাবেক এ দিন দুপুর দু’টোয় বিচারপতি দত্তের সামনে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল ডিজি জিএমপি রেড্ডির।

কিন্তু এ দিন সকাল সাড়ে দশটায় প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চে গিয়ে ডিজি-কে তলবের নির্দেশ স্থগিত করার আবেদন জানায় রাজ্য সরকার। তবে কেন তারা এর বিরোধিতা করছে, তা সরকারের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়নি। আইনজীবীদের অনেকে বলছেন, হাইকোর্টে ডিজি বা পুলিশ কমিশনারকে ডাকার নজির ভূরি ভূরি রয়েছে। বামফ্রন্ট আমলে এক ডিজি-কে ডেকে হাইকোর্ট তাঁকে জেলে পাঠানোর রায়ও শুনিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে জরিমানাও করেছে। আইনজীবীদের একাংশের ধারণা, পাড়ুই মামলার ক্ষেত্রে অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেফতার না-করার কোনও যুক্তি ডিজি-র কাছে ছিল না। তাই ডিজি-কে আদালতে হাজির না-করাতে মরিয়া সরকার এই রাস্তা নিয়ে থাকবে।

অথচ পাড়ুই থানার দুই অফিসারের পলিগ্রাফ পরীক্ষার জন্য সিউড়ি আদালতে আবেদন করেছিল সিট। সেই আবেদন এ দিন মঞ্জুর করেছে সিউড়ি আদালত। হাইকোর্টের আইনজীবীদের একাংশ বলছেন, এ দিন ডিজি হাইকোর্টে এসে এই খবরটা জানাতে পারতেন। তা হলে রাজ্য সরকারের মুখরক্ষা হতে পারত। তার বদলে ডিজি-র হাজিরার সটান বিরোধিতা করে মামলাটিকেই আরও দীর্ঘায়িত করে দেওয়া হল। সরকারের আবেদন মেনে এ দিন দুপুর ১২টা নাগাদ তিন সপ্তাহের স্থগিতাদেশ মঞ্জুর করে ডিভিশন বেঞ্চ।

মমতা-অনুব্রতর এক মঞ্চে পাশাপাশি যে ছবি, সেই প্রসঙ্গে বিচারপতি দত্তের মন্তব্য নিয়েও এ দিন ডিভিশন বেঞ্চের কাছে আপত্তি জানিয়েছে রাজ্য সরকার। ওই ছবি দেখেই অনুব্রতকে ‘আশীর্বাদ-ধন্য’ বলেছিলেন বিচারপতি দত্ত। জনমানসে এ থেকে কী বার্তা যাচ্ছে, সে প্রশ্নও তুলেছিলেন। এ দিন প্রধান বিচারপতি অবশ্য বলেন, ছবির বিষয়টি এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কারও ছবি দেখে কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় না। সেই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেন, অনুব্রতকে ‘মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদ-ধন্য’ বলে উল্লেখ করে বিচারপতি দত্ত ঠিক করেননি।

বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী এর পর জিপি-র কাছে জানতে চান, বিচারপতি দত্তের এজলাসে চলা পাড়ুই মামলার আবেদনকারী কারা ছিলেন? জিপি বলেন, কয়েক জন অভিযুক্ত ব্যক্তি ওই মামলা করেন সিআইডি তদন্ত চেয়ে। বিচারপতি বাগচী তখন জিপি-কে বলেন, অনুব্রত পুলিশকে বোমা মারার কথা বলার সঙ্গে সাগর ঘোষ খুনের কোনও সম্পর্ক আছে কি? কোনও চক্রান্ত ছিল? জিপি তার উত্তর দেননি। ডিভিশন বেঞ্চ পাড়ুই মামলার সমস্ত তদন্ত রিপোর্ট এবং ডিজি-র পাঠানো রিপোর্ট দেখতে চেয়েছে। তিন সপ্তাহের মধ্যে রাজ্য সরকারকে হলফনামা দিয়ে নিজেদের বক্তব্য জানাতে হবে।

হাইকোর্টের আইনজীবীদের একাংশ মনে করাচ্ছেন, গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচন সংক্রান্ত মামলাতেও প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের একটি নির্দেশ ঘিরে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। রাজ্য নির্বাচন কমিশন বনাম রাজ্য সরকারের সেই মামলায় বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দারের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচির ডিভিশন বেঞ্চেই আবেদন করেছিল রাজ্য সরকার। ওই ডিভিশন বেঞ্চের প্রথম নির্দেশ (১৪ মে, ২০১৩) ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়। ডিভিশন বেঞ্চ তার নির্দেশে ‘দু’পক্ষের সম্মতি’র কথা উল্লেখ করেছিল। রাজ্য সরকারের সঙ্গে কথা বলে কমিশনকে নির্বাচনের দিন ঠিক করতে বলেছিল। অসন্তুষ্ট নির্বাচন কমিশন ওই রায়ের ব্যাখ্যা চেয়ে ফের আবেদন করে। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ তখন পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করার ব্যাপারে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের একচ্ছত্র ক্ষমতা মেনে নেয়। তখন কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে বিতর্কে রফা চেয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই শেষ পর্যন্ত জট খোলে। বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার একেবারে গোড়ায় যে রায় দিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট কার্যত সেই নির্দেশই বহাল রাখে।

ডিভিশন বেঞ্চের এ দিনের রায়ের বিরুদ্ধে এখন সেই সুপ্রিম কোর্টেই যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন মামলার অন্যতম আবেদনকারী হৃদয় ঘোষের আইনজীবী শীর্ষেন্দু সিংহরায়। তিনি বলেন, “আমরা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা ভাবছি।” হৃদয়বাবু নিজে বলেন, “ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে বিচার বিলম্বিত হল এবং অভিযুক্তরা অর্থাৎ অনুব্রত ও তাঁর বাহিনী আরও সাহস পেয়ে গেল। এর পর গ্রামে আমাদের পক্ষে নিরাপদে বসবাস করা আরও কঠিন হবে।”

উল্টো দিকে রায় শোনার পরে স্পষ্টতই স্বস্তির ছাপ অনুব্রতর চোখেমুখে। স্বস্তির কথা স্বীকারও করেন তিনি। আগামী তিন সপ্তাহ পর যখন পাড়ুই শুনানি ফের শুরু হবে, তার মধ্যে বীরভূমের ভোট-পর্ব মিটে যাবে। আত্মবিশ্বাসী গলায় অনুব্রত বলেন, “আমার কী হবে ভেবে, আপনাদের ঘুম ছুটে যেতে পারে। কিন্তু ও নিয়ে আমার কোনও দিনই টেনশন ছিল না। আমি তো কিছু করিনি।” আগাম জামিন নেওয়ার সম্ভাবনা খারিজ করে তাঁর মন্তব্য, “চুরিও করিনি, ডাকাতিও করিনি। কিছুই না করে, কেন জামিন নেব!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anubrata parui case high court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE