Advertisement
০৩ মে ২০২৪

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল এফআইআর করতেই হবে

তাপস পালের ব্যাপারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এফআইআর না করে পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ভাঙল কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে আইনজীবী মহলে। হাইকোর্টের অনেক আইনজীবীই বলছেন, নির্দিষ্ট একটি দলের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসায় উস্কানিমূলক মন্তব্য করার পরেও তৃণমূল সাংসদ তাপস পালকে গ্রেফতার না করে রাজ্য পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ভেঙেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৪ ০৩:৫৬
Share: Save:

তাপস পালের ব্যাপারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এফআইআর না করে পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ভাঙল কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে আইনজীবী মহলে।

হাইকোর্টের অনেক আইনজীবীই বলছেন, নির্দিষ্ট একটি দলের সমর্থকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসায় উস্কানিমূলক মন্তব্য করার পরেও তৃণমূল সাংসদ তাপস পালকে গ্রেফতার না করে রাজ্য পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ভেঙেছে। কোনও অপরাধমূলক অভিযোগের খবর পেলে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত এফআইআর করতে বাধ্য বলে ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি পি সদাশিবমের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চ একটি মামলায় নির্দেশ দিয়েছিল।

হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের মতে, সুপ্রিম কোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছে, ভারতীয় পুলিশ আইন (১৮৬১)-এর ২৩ ধারায় পুলিশকে সেই কাজটাই করতে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শান্তিশৃঙ্খলা অক্ষণ্ণ রাখতে ও শান্তি বজায় রাখতে পুলিশ যে কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে।

অধিকাংশ আইনজীবীই বলছেন, ১৪ জুন তাপস যেখানে বক্তৃতা করেছেন, সেখানকার পুলিশেরই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এফআইআর করা উচিত ছিল। জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, ১৪ জুন নাকাশিপাড়া এবং তেহট্ট থানার যে পাঁচটি গ্রামে তাপস গিয়েছিলেন, সব জায়গাতেই পুলিশ ছিল। তাঁরা কী করছিলেন?

তেহট্টের এক পুলিশকর্তা বলেন, “আমরা ঘটনাস্থলে ছিলাম ঠিকই। তবে একটু দূরে। তাই সাংসদ কী বলছেন, শুনতে পাইনি। আমাদের কাছে কেউ অভিযোগও করেনি।” নাকাশিপাড়ার ওসি আবার দাবি করেছেন, সাংসদের গ্রাম-সফর নিয়ে তিনি কিছু জানতেন না। তেহট্টের এসডিপিও সুনীল শিকদার ফোন ধরেননি। তৎকালীন পুলিশ সুপার সব্যসাচীরমণ মিশ্র ফোন ধরে কেবল বলেছেন, “আমি এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।”

মঙ্গলবার নাকাশিপাড়া ব্লক বিজেপি-র তরফে অভিযোগ দায়ের করে বলা হয়েছে, ‘তাপস পালের কু-কথায় আমরা আতঙ্কিত। তাপসের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করা হোক।’ মঙ্গলবার রাতে কৃষ্ণনগরের কোতোয়ালি থানায় মহিলা সমিতির ১৫ জন সদস্যও তাপসের এই মন্তব্যের পরে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে ডায়েরি করেছেন। পুলিশ এই অভিযোগগুলিকেও এফআইআর হিসেবে গ্রাহ্য করেনি। কেন? নাকাশিপাড়ার ওসি রাজা সরকারের বক্তব্য, “অভিযোগকে এফআইআর হিসাবে গণ্য করার নির্দেশ আসেনি উপরমহল থেকে। তাই আমরা প্রাথমিক ভাবে তদন্তটা করছি শুধু।” মঙ্গলবার দায়িত্ব নেওয়া নদিয়ার এসপি অর্ণব ঘোষ কোনও মন্তব্যই করতে চাননি।

গত ১৪ জুন তৃণমূলের সাংসদ নদিয়ার নাকাশিপাড়া এবং পলাশিতে যে বক্তৃতা করেছেন, তাতে সিএপিএম সমর্থকদের খুন করাতেও উস্কানি দেওয়া হয়েছে। আইনজীবীদের মতে, পুলিশের উচিত ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩ ক (১) এবং ৫০৫ (২) ধারায় মামলা করা। দু’টি ধারাই জামিন অযোগ্য। এ ছাড়া, তাপসের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারায় অপরাধমূলক কাজকর্মে উস্কানি দেওয়া এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর মামলাও পুলিশ করতে পারত বলে জানাচ্ছেন আইনজীবীরা। ওই ধারাটি অবশ্য জামিনযোগ্য। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীদের অনেকে বলছেন, তাপস যে মন্তব্য করেছেন, যে ভাবে কিছু মানুষকে ভয় দেখিয়েছেন, তাতে তাঁর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১১৫ ধারাতেও (খুন বা যাবজ্জীবনের সাজা হতে পারে এমন অন্য অপরাধে উস্কানি) মামলা করার সুযোগ রয়েছে পুলিশের কাছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী করুণা নন্দী বলেন, কোনও ব্যক্তি কোথাও উস্কানিমূলক বক্তৃতা করলে তিনি অপরাধী বলেই গণ্য হবেন।

ওই বক্তৃতার জেরে যদি কোনও হিংসাত্মক ঘটনা না-ও হয়, তা হলেও বক্তা অপরাধী। তাঁর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১০৭ এবং ১০৮ ধারায় (বক্তৃতা বা লেখার মাধ্যমে এলাকার শান্তি ভঙ্গ করা) এফআইআর করতেই হবে।

তৃণমূলের আইনজীবী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাপসের মন্তব্যের কড়া নিন্দা করলেও তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের না-করা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা মানতে চাননি। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “তাপসের ওই বক্তব্যের জেরে কোনও হিংসার ঘটনা ঘটেনি, শান্তি বিঘ্নিত হয়নি। তা হলে এফআইআর দায়ের হবে কেন?”

কলকাতা হাইকোর্টের এক আইনজীবী কিন্তু মনে করাচ্ছেন, গত বছর যে মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিল সেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন কল্যাণ। তিনি এফআইআর দায়ের করার গুরুত্ব সম্পর্কে সাংবিধানিক বেঞ্চের বক্তব্যকেই সমর্থন করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে কল্যাণ এ দিন বলেন, “দু’টির প্রেক্ষিত আলাদা। ওটা অপরাধ সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।”

নবান্নে রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলও মুখে কুলুপ এঁটেছেন। স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে নারাজ। তবে নবান্ন সূত্রের খবর, দিল্লির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তাপস পালের বক্তব্য নিয়ে রাজ্যের কাছে রিপোর্ট তলব করে যে চিঠি দিয়েছিল তা এদিন মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীই ঠিক করবেন ওই চিঠির জবাব কী দেওয়া হবে কিংবা আদৌ দেওয়া হবে কি না।

তাপসের শাস্তি চেয়ে মামলা

তৃণমূল সাংসদ তাপস পালের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের আর্জি জানিয়ে বুধবার কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা করা হয়েছে। বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের আদালতে মামলাটি করেছেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা তথা হাইকোর্টের আইনজীবী শমিত সান্যাল। শমিতবাবুর আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন জানান, আদালতে আবেদন জানিয়ে বলা হয়েছে, ওই সাংসদ নাকাশিপাড়া ও তেহট্টে যে-উক্তি করেছেন, তা সংবিধান-বিরোধী। তাপস ওই উক্তি করে ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারা-উপধারাও লঙ্ঘন করেছেন। সেই জন্য তাঁকে গ্রেফতার করে চার্জশিট পেশ করা হোক। আইনজীবী আরও জানান, ওই উক্তির জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও নির্বাচন কমিশনেরও যে তাপসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, আবেদনে সে-কথাও বলা হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

supreme court hate speech FIR tapas pal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE