Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সমবায় সমিতিকে ত্রাণ তহবিলে দানের ফরমান

মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল ভরাতে হবে। দায় রাজ্যের সাড়ে ছ’হাজার সমবায় সমিতির। সমবায় দফতর থেকে রীতিমতো নির্দেশিকা জারি করে বলা হয়েছে, আগামী ১৮ নভেম্বর সমবায় সপ্তাহের অনুষ্ঠানে ত্রাণ তহবিলের জন্য টাকা দিতে হবে। শুধু তাই নয়, যে সব সমিতি মোটা টাকা দান করবে তাদের জন্য ইনামেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। কী সেই ইনাম? সরকারি নির্দেশনামায় বলা হয়েছে, লক্ষাধিক টাকা ত্রাণ তহবিলে দিলে সংশ্লিষ্ট সমবায় সমিতির অনুষ্ঠানে কর্তাদের বিশেষ অতিথির মর্যাদা দেওয়া হবে। বসার সুযোগ মিলবে প্রথম সারিতে।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১৬
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল ভরাতে হবে। দায় রাজ্যের সাড়ে ছ’হাজার সমবায় সমিতির।

সমবায় দফতর থেকে রীতিমতো নির্দেশিকা জারি করে বলা হয়েছে, আগামী ১৮ নভেম্বর সমবায় সপ্তাহের অনুষ্ঠানে ত্রাণ তহবিলের জন্য টাকা দিতে হবে। শুধু তাই নয়, যে সব সমিতি মোটা টাকা দান করবে তাদের জন্য ইনামেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। কী সেই ইনাম? সরকারি নির্দেশনামায় বলা হয়েছে, লক্ষাধিক টাকা ত্রাণ তহবিলে দিলে সংশ্লিষ্ট সমবায় সমিতির অনুষ্ঠানে কর্তাদের বিশেষ অতিথির মর্যাদা দেওয়া হবে। বসার সুযোগ মিলবে প্রথম সারিতে।

গত ৩১ অক্টোবর সমবায় দফতর যখন এই নির্দেশিকা জারি করেছে, তখনও পর্যন্ত ঠিক ছিল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমবায় সপ্তাহের অনুষ্ঠানে হাজির থাকবেন। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে বসানোর ‘অফার’ দিয়ে বেশ কিছু সমবায় সমিতির কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা ত্রাণ তহবিলের জন্য আদায় করা সম্ভব বলে আশা করেছিলেন সমবায় কর্তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী আসতে পারবেন না বলে তাঁর দফতর থেকে সমবায় দফতরকে জানানো হয়েছে। তাঁর বদলে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র সমবায় সপ্তাহ পালনের অনুষ্ঠানে যাবেন। দফতরের কর্তাদের আশঙ্কা, মুখ্যমন্ত্রীর বদলে অর্থমন্ত্রী আসায় প্রথম সারিতে বসার আকর্ষণ কিঞ্চিৎ কমতে পারে। তাই বিভিন্ন স্তরের সমবায় আধিকারিকদের লাভজনক সমিতিগুলি থেকে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা তোলার জন্য নামানো হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল বরাবরই দানের টাকায় চলে। কোষাগারের টাকা এখানে আসে না বলে এই অর্থের অডিটও হয় না। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজের ইচ্ছামতো টাকা খরচ করতে পারেন। প্রশাসনের একটি সূত্রের বক্তব্য, এখন মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের টাকাতেই একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের বেতন দেওয়া হচ্ছে। একই ভাবে বৃত্তি থেকে চিকিৎসা, বিভিন্ন খাতেই এই তহবিলের অর্থ খরচ হচ্ছে বলে দাবি ওই সূত্রটির। ফলে টাকার টান রয়েছে সর্বত্রই। সে কারণেই এ বছর ডাক পড়েছে সমবায় সমিতির।

সমবায়মন্ত্রী জ্যোতির্ময় করের ব্যাখ্যা, “সমিতিগুলি লাভ করলে সেই টাকায় সদস্যদের ডিভিডেন্ড দেয়। সরকারও অংশীদারিত্ব অনুযায়ী ডিভিডেন্ড পায়। এ বার ডিভিডেন্ডের পাশপাশি মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলেও সাহায্য করতে বলা হয়েছে। গত কয়েক বছরে সমবায় সমিতিগুলি থেকে ত্রাণ তহবিলে সহায়তার পরিমাণ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। এ বছর তা বাড়ানো হবে।”

মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য কত টাকা তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে? সমবায়মন্ত্রীর বক্তব্য, “সেই ভাবে কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়নি। লাভজনক সমিতিগুলি যেমন টাকা দেবে, তার পুরোটাই মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা দেওয়া হবে।” মন্ত্রীমশাই কিছু না বললেও জেলায় জেলায় ত্রাণ তহবিলের টাকা সংগ্রহে নেমে পড়া আধিকারিকদের একাংশ জানাচ্ছেন, অন্তত এক কোটি টাকা তো তুলে দিতেই হবে। সেই লক্ষ্যেই নামা হয়েছে।

কিন্তু হঠাৎ সমবায় সমিতিগুলি থেকে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য টাকা তোলার পরিকল্পনা কেন?

প্রশাসন সূত্রের খবর, কোষাগারের টাকায় মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল ভরানো নিয়ে তাদের আপত্তি জানিয়েছে সিএজি। কেন বাজেট বরাদ্দের অর্থে দান-বিলি করা হচ্ছে, রাজ্যের কাছে তা-ও জানতে চেয়েছে ওই হিসেব পরীক্ষক সংস্থা। যদিও সিএজি-র পাঠানো সেই ‘নোট’ ফাইলবন্দি রেখে চলতি আর্থিক বছরে এ পর্যন্ত (২০১৪-১৫) আরও ৪ কোটি ১০ লক্ষ টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করেছে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর।

কিন্তু সরকারি কোষাগার থেকে টাকা তুলে এ ভাবে ত্রাণ তহবিলে জমা করা যায় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নবান্নে। সরকারি সূত্র বলছে, ২০১৩ সালের মার্চ মাসে প্রথম বার নিজেদের বাজেটের টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করে স্বরাষ্ট্র দফতর। নবান্নে এক কর্তা জানান, সেই মাসের ২ তারিখে কলকাতার টাউন হলে এক অনুষ্ঠানে মন্তেশ্বরের ১৬৬ জন ‘বঞ্চিত’ চাষির হাতে মোট ৪৫ লক্ষ টাকা ‘সাহায্য’ তুলে দেওয়ার সময়ে মমতা বলেছিলেন, “ত্রাণ দিতে গিয়ে তহবিলের প্রায় সব টাকাই শেষ হয়ে গেল....।” ওই বক্তব্যের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে, ৫ মার্চ স্বরাষ্ট্র দফতর তাদের পরিকল্পনা বহির্ভূত খাত থেকে ১ কোটি টাকা তুলে জমা দিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। সেই থেকে রাজকোষের টাকায় ত্রাণ তহবিল ভরানোর কাজ চললেও সিএজি-র আপত্তিতে কিছুটা বেকায়দায় সরকার। সেই কারণেই সরাসরি কোষাগারের টাকা ত্রাণ তহবিলে না ঢেলে সমবায় সমিতির কাছ থেকে ‘দান আদায়’-এর পরিকল্পনা করা হয়েছে।

সমবায় দফতরের এক কর্তা অবশ্য জানাচ্ছেন, অতীতেও সমবায় সমিতিগুলি মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে টাকা দিয়েছে। সমবায়মন্ত্রী নিজেই এক সময় কন্টাই কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান ছিলেন। তখন তিনিও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে টাকা তুলে দিয়েছিলেন। ফলে সমবায় সমিতিগুলিকে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করতে বলে অন্যায় কিছু করা হয়নি।

যদিও সমবায় কর্তাদের অনেকে জানিয়েছেন, আসলে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অর্থদানের বিষয়টি বরাবরই সমিতিগুলির ইচ্ছের উপর নির্ভর করত। কিন্তু এ বারই প্রথম সরকারি নির্দেশনামা জারি করে টাকা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। টাকা দিলে প্রথম সারিতে বসতে দেওয়ার প্রলোভনও দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে টাকা আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে সমবায় অফিসারদের জেলাস্তরে নামিয়েও দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু তাতেও সংশয় কাটছে না। কেন? দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যে ৬৪০০টি প্রাথমিক কৃষি সমবায় সমিতি (প্যাকস) রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র হাজার দেড়েক সমিতি লাভে চলে। বাকিগুলি হয় বন্ধ, নয়তো বা লোকসানে চলছে। লাভজনক সমিতিগুলি থেকেই টাকা পেতে জোর দেওয়া হচ্ছে।

এ ছাড়াও রাজ্যের সমস্ত বড় আবাসন সমবায়গুলির কাছেও দফতরের তরফ থেকে চিঠি পাঠিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করতে বলা হয়েছে। ১৭টি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক এবং ১০টির মতো অ্যাপেক্স ব্যাঙ্কও রয়েছে। এরাও যাতে বড় অঙ্কের টাকা ত্রাণ তহবিলে দেয় তার জন্য সমবায় দফতর উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE