Advertisement
০৩ মে ২০২৪

হাতে এসেও পুলিশের ভুলে ফস্কে গেল মালখান

অন্ধকারে ওত পেতে থাকা পুলিশ বাহিনীর এক জন হাত বিশেক দূরত্বে ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেয়ে চেঁচালেন, “সারেন্ডার কর্ মালখান।” আর রবিবার রাতে কেএলও-র ওই জঙ্গিনেতা মালদহের গাজলে এক রকম হাতে এসেও ফস্কে যাওয়ার পরে পুলিশকর্তারা মনে করছেন, ওই চিৎকারই তাঁদের কাল হল।

মালখান সিংহ

মালখান সিংহ

পীযূষ সাহা ও সুরবেক বিশ্বাস
গাজল ও কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২৮
Share: Save:

অন্ধকারে ওত পেতে থাকা পুলিশ বাহিনীর এক জন হাত বিশেক দূরত্বে ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেয়ে চেঁচালেন, “সারেন্ডার কর্ মালখান।” আর রবিবার রাতে কেএলও-র ওই জঙ্গিনেতা মালদহের গাজলে এক রকম হাতে এসেও ফস্কে যাওয়ার পরে পুলিশকর্তারা মনে করছেন, ওই চিৎকারই তাঁদের কাল হল।

কারণ, তাঁদের বক্তব্য, চিৎকারেই মালখান সিংহ বুঝতে পারে, পুলিশ তাকে ঘিরে ফেলেছে। তৎক্ষণাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো ছিটকে যায় সে। তার পর চোখের পলক ফেলার আগেই অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় ইটভাটার সামনে বিশাল চওড়া গর্ত লাফ দিয়ে পেরিয়ে যায়। “স্বচক্ষে দেখেছি, তবু এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে, কোনও মানুষ অত বড় গর্ত ওই ভাবে লাফ দিয়ে পেরিয়ে যেতে পারে,” বলছেন এক পুলিশ অফিসার।

পুলিশ বাহিনী যতক্ষণে ঘুরপথে ওই গর্ত পেরোল, ততক্ষণে মালখান ইটভাটায় পাজা করে রাখা ইটের দেওয়ালের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে দৌড়তে শুরু করেছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, তাড়া করে মালখানকে ধরা যাবে না বুঝে পুলিশ শেষমেশ গুলি চালাতে শুরু করে। কিন্তু পাল্টা নিজের নাইন এম এম পিস্তল থেকে প্রায় দশ রাউন্ড গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায় মালখান।

রাজ্য পুলিশের মালদহ রেঞ্জের ডিআইজি সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেন, “গুলি চলার কোনও খবর নেই। অল্পের জন্য মালখান সিংহ আমাদের হাতছাড়া হয়েছে।” তাঁর বক্তব্য, পুলিশের তাড়া খেয়ে মালখান গমের খেতে ঢুকে পড়ে, তার পর অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে পালায়।

তবে রবিবার রাতের ঘটনাস্থল, গাজলের ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, রবিবার রাতে তাঁরা আধ ঘণ্টা ধরে গুলির শব্দ শুনেছেন। সোমবার দুপুরে ওই গ্রামে গেলে সাবিত্রী সরকার, মহুয়া রায়রা বলেন, “সারা রাত ঘুমোতে পারিনি।” গ্রামবাসীদের বক্তব্য, “রাত সাড়ে দশটা নাগাদ গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। তার পর প্রায় আধ ঘণ্টা গুলির শব্দ শুনেছি।” গ্রামের অতুল সরকার, বিপিন রায়দের কথায়, “ভোরবেলা পুলিশ ও সিআরপি জওয়ানেরা মালখান সিংহকে খুঁজতে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঢুকে তল্লাশি চালিয়েছে।” এ দিন দুপুরেও ফতেপুর গ্রামে দেখা গিয়েছে, সেখানে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী। কিন্তু মালখানের টিকিটিরও দেখা নেই।

অথচ বামনগোলার কাংসা গ্রামের বাসিন্দা মাধব মণ্ডল ওরফে মালখান যে রবিবার রাতে তার নিজের জেলা মালদহে ঢুকবে, সেই ব্যাপারে তিন দিন আগে গোয়েন্দা-তথ্য পেয়েছিল পুলিশ। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, রবিবার সকালে নেপালের ধুলাবাড়ি থেকে প্রথমে বিহারের ঠাকুরগঞ্জ হয়ে কাটিহারে ঢোকে মালখান। সেখান থেকে ট্রেনে সন্ধ্যায় পৌঁছায় একলাখি স্টেশনে। যেখানে এক জন মোটর সাইকেল নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। মোটর সাইকেলে মালখান গাজলের বাগসরাই গ্রামের কাছে পৌঁছয়। তার পর বড় রাস্তা ছেড়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে ১৫ কিলোমিটার দূরের হবিবপুরের বিনোদপুর গ্রামের কাছে একটি ডেরার উদ্দেশে হাঁটাপথে রওনা দেয় মালখান। আর বাগসরাই থেকে ফতেপুর গ্রামে ঢোকার রাস্তাতেই ওঁত পেতেছিল ২০-২৫ জনের পুলিশ বাহিনী।

কিন্তু চেঁচিয়ে মালখানকে আত্মসমর্পণ করতে বলে পুলিশ তাকে সতর্ক করে দিল কেন?

রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “লোকটা যে মালখানই, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হতে ও রকম করা হয়েছিল। মালখানের বদলে যদি নির্দোষ কেউ হত আর আমরা গুলি চালাতাম, তা হলে কী হত?” কিন্তু মালখান যে এতটা ক্ষিপ্র, সেটা তাঁদের জানা ছিল না বলে ওই অফিসার স্বীকার করে নিচ্ছেন।

তবে পুলিশের একাংশের মতে, মালখানের মতো দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে ধরতে যতটা প্রস্তুতির প্রয়োজন, রবিবার রাতে পুলিশবাহিনী সে রকম তৈরি ছিল না। এক অফিসারের বক্তব্য, এ সব ক্ষেত্রে শার্প শু্যটার বা নিখুঁত বন্দুকবাজ দলে থাকা প্রয়োজন হলেও সে রকম কেউ রবিবার রাতে গাজলে ছিলেন না। তা ছাড়া, খুব সন্তর্পণে মালখানকে চার দিক থেকে ঘিরে নিতে হত বলেও মনে করেন ওই অফিসার।

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, তোলা আদায়ের উদ্দেশ্যে এবং কয়েক জন লিঙ্কম্যানের সঙ্গে দেখা করার জন্য নেপাল থেকে বেরিয়ে মালখান ফের মালদহে ঢোকার ঝুঁকি নিয়েছিল।

মালখানকে গ্রেফতার না করা গেলেও তার শাগরেদ, কেএলও জঙ্গি নবানু বর্মনকে শনিবার পুলিশ বেঙ্গালুরু থেকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশের দাবি, গত ডিসেম্বরে হবিবপুরে বাসে গুলি চলার ঘটনায় মালখানের পাশাপাশি নবানুও জড়িত। ওই ঘটনায় জড়িত অন্য দুই কেএলও জঙ্গি কুমুদ মণ্ডল ও ছোটুকে আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনও অধরা থেকে গেল মালখান।

এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, “বড় ব্যাটসম্যানের ক্যাচ ফস্কালে মাসুল দিতে হয়। রবিবার মালখানকে ফস্কানোর কী গুনাগার আমাদের দিতে হবে কে জানে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

malkhan singh pijush saha surbek biswas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE