Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ এক অন্য এয়ারলিফ্ট, ইতিহাসের পাতায় রয়ে গিয়েছে সেই কাহিনি

উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় লক্ষাধিক ভারতীয়কে এয়ার ইন্ডিয়া উদ্ধার করে এনেছিল পশ্চিম এশিয়া থেকে। ইরাকি হামলায় বিধ্বস্ত কুয়েত থেকে ভারতীয়দের উদ্ধার করে আনার সেই ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে বলিউড মুভি ‘এয়ারলিফ্ট’। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে আরও দুঃসাহসিক এয়ারলিফ্টের ঘটনাও রয়েছে। অনেকেই খবর রাখি না সেই হাই প্রোফাইল এয়ারলিফ্টের।

মুক্ত মুসোলিনি।

মুক্ত মুসোলিনি।

ঈশানদেব চট্টপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৫২
Share: Save:

উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় লক্ষাধিক ভারতীয়কে এয়ার ইন্ডিয়া উদ্ধার করে এনেছিল পশ্চিম এশিয়া থেকে। ইরাকি হামলায় বিধ্বস্ত কুয়েত থেকে ভারতীয়দের উদ্ধার করে আনার সেই ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে বলিউড মুভি ‘এয়ারলিফ্ট’। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে আরও দুঃসাহসিক এয়ারলিফ্টের ঘটনাও রয়েছে। অনেকেই খবর রাখি না সেই হাই প্রোফাইল এয়ারলিফ্টের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝেই বন্দি হয়ে পড়া ইতালীয় ডিক্টেটর বেনিটো মুসোলিনিকে বন্দিশালা থেকে যেভাবে উড়িয়ে এনেছিলেন জার্মান স্বৈরশাসক অ্যাডলফ হিটলার, তেমন দুঃসাহসিক অথচ রক্তপাতহীন অভিযানের কথা ইতিহাসে কমই শোনা যায়।

১৯৪৩ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি আর মিত্রশক্তির লড়াই তুঙ্গে। জার্মানি আর জাপানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমেরিকা, সোভিয়েত রাশিয়া আর ব্রিটেনের বিরুদ্ধে লড়ছে বেনিটো মুসোলিনির ইতালি। আমেরিকা-ব্রিটেন-রুশ বাহিনী এক সময় আর রাখঢাক না করে সরাসরি আক্রমণ করল ইতালিয় ভূখণ্ডেই। মিত্রশক্তির বিমানবাহিনী ইতালির রাজধানী রোমের আকাশ থেকে ব্যাপক বোমা বর্ষণ করল। ১৯৪৩-এর এই হামলায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয় ইতালি। ফলে বেনিটো মুসোলিনির শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ইতালির গ্র্যান্ড কাউন্সিল অফ ফ্যাসিজমের সদস্যরাই। অনাস্থা এনে মুসোলিনিকে ভোটাভুটিতে হারিয়ে দেন তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মীরাই। তার পর সে দেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজাকে বলা হয়, মুসোলিনিকে পদচ্যুত করতে। সর্বশক্তিমান ফ্যাসিস্ট দল ও সরকারে যাঁরা এক সময় ছিলেন মুসোলিনির খুব কাছের, তাঁদের বিদ্রোহে উজ্জীবিত রাজা মুসোলিনিকে সরকারের শীর্ষ পদ থেকে পদচ্যুত করেন। তার পর গ্রেফতার করে নির্জন দ্বীপে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন।

জার্মানির স্বৈরশাসক অ্যাডলফ হিটলার মুসোলিনির এই পরিণতি মেনে নিতে পারেননি। প্রথমত, মুসোলিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর অন্যতম সহযোগী। দ্বিতীয়ত, মুসোলিনি ছিলেন হিটলারের ব্যক্তিগত বন্ধুও। তাই মুসোলিনিকে ক্ষমতাচ্যুত করার ঘটনাকে হিটলার ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি নিজের সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন, যে কোনও মূল্যে মুক্ত করতে হবে বেনিটো মুসোলিনিকে। সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্তা অটো স্কর্জেনিকে হিটলার বেছে নিয়েছিলেন মুসোলিনি উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। দায়িত্ব পেয়েই স্কর্জেনি ইতালির বিভিন্ন রেডিও বার্তায় আড়ি পাততে শুরু করেন। জানতে পারেন, মুসোলিনিকে বন্দি করে ঘোরানো হচ্ছে গোটা ইতালিতে। মাঝেমধ্যেই বদলে দেওয়া হচ্ছে তাঁর বন্দিশালা। এমনই এক রেডিও বার্তা থেকে হিটলারের বিশেষ কম্যান্ডো বাহিনীর নেতা স্কর্জেনির কাছে খবর আসে, অ্যাপেনাইন পর্বতে ক্যাম্পো ইমপেরাটোরে রিসর্টে বন্দি করা হয়েছে মুসোলিনিকে। লোকালয় থেকে বহু উঁচুতে দুর্গম পাহাড়চুড়োর রিসর্টে মুসোলিনিকে রাখা হয়েছিল জার্মানির নাগাল এড়ানোর জন্যই। কিন্তু ইতালির তৎকালীন শাসকরা বুঝতে পারেননি, হিটলারের বাহিনী সমতল থেকে পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করবে না। বরং মুসোলিনিকে ছাড়াতে তারা আকাশ থেকে পাহাড়চুড়োয় নামবে।

মুসোলিনি উদ্ধার অভিযানে ব্যবহৃত হয়েছিল এই বিমানটি।

জুলাই মাসে বন্দি করা হয়েছিল মুসোলিনিকে। ১২ সেপ্টেম্বর অটো স্কর্জেনির নেতৃত্বে ১০০ জন জার্মান কম্যান্ডো গ্লাইডিং করে অতর্কিতে আকাশ থেকে নেমে পড়েন ক্যাম্পো ইমপেরাটোরে চত্বরে। ঘিরে ফেলেন গোটা রিসর্ট। ২০০ রক্ষীর বিশাল বাহিনী ঘিরে রেখেছিল মুসোলিনির বন্দিশালা। কিন্তু ১০০ জার্মান কম্যান্ডো কোনও লড়াই না করে মুসোলিনিকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। আসলে ইতালীয় সেনার এক পদস্থ কর্তাকে নিজের দলে টেনেছিলেন স্কর্জেনি। তাঁকে নিয়ে ক্যাম্পো ইমপেরাটোরেতে হানা দেয় হিটলারের বাহিনী। সেখানে পৌঁছে ইতালীয় সেনার পদস্থ কর্তাটি নিজের দেশের সেনাকর্মীদের বলেন, অভিযানে সহযোগিতা না করলে দেশদ্রোহের অপরাধে সাজা দেওয়া হবে। অফিসারের হুঁশিয়ারি শুনে জার্মান কম্যান্ডোদের আর বাধা দেয়নি ইতালীয় বাহিনী। ফলে একটিও গুলি খরচ না করে ক্যাম্পো ইমপেরাটোরে থেকে বেনিটো মুসোলিনিকে মুক্ত করেন স্কর্জেনিরা। ক্যাম্পো ইমপেরাটোরের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেওয়ার পর মুসোলিনির ঘরে গিয়ে স্কর্জেনি বলেছিলেন, ‘‘ডিউস, ফ্যুয়েরার আমাকে পাঠিয়েছেন আমাকে মুক্ত করার জন্য।’’ আনন্দে বিহ্বল মুসোলিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি জানতাম আমার বন্ধু হিটলার আমাকে ভুলে যাবেন না।’’ এর পর জার্মান বিমানবাহিনীর এয়াক্র্যাফ্টে করে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বেনিটো মুসোলিনিকে। জার্মানি ইতালির যে অংশ দখল করে নিয়েছিল আগেই, সেই অংশকে নিয়ে ইতালিয়ান সোশ্যাল রিপাবলিক নামে পৃথক দেশ গঠন করে মুসোলিনিকে সেখানকার রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করেন হিটলার।

বার্লিনে ওটো স্করজেনির সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই দুঃসাহসিক অভিযান, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে হাই প্রোফাইল এয়ারলিফ্ট। এই অভিযানের পর গোটা ইউরোপে জার্মান বাহিনীর অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতার কথা মুখে মুখে ফিরতে শুরু করেছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘‘অটো স্কর্জেনি ইউরোপের সবচেয়ে বিপজ্জনক মানুষ।’’ তাতে হিটলারের সেনা যে গৌরবান্বিতই বোধ করেছিল, তা বলা বাহুল্য। দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য কম্যান্ডো বাহিনীকে বার্লিনে বিশাল সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন হিটলার। প্রোমোশন হয়েছিল অটো স্কর্জেনিরও। তবে এই এয়ারলিফ্টের কথা বিস্মৃতির অতলে চলে গিয়েছে কালের নিয়মে।

আরও পড়ুন:
৩২ বছর আগেও বেঁচে ছিলেন হিটলার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE