Advertisement
E-Paper

ঋণদাতাদের সঙ্গে তীব্র মতভেদ, ইউরো ছাড়তে পারে গ্রিস

‘ইউরো’র ভাগ্যকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা। এক দিকে, অসি শানিয়ে গ্রিস। অন্য দিকে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ান (ইইউ), আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ)-এর মতো ঋণদাতারা। এ পালায়, কে ইংরেজ, কে সিরাজ, কে-ই বা মীরজাফর তা অবশ্য বোঝা কঠিন।

রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৫ ১৩:৫১
বৈঠকের ফাঁকে জার্মান চ্যান্সেলার অ্যাঞ্জেলা মের্কেলের সঙ্গে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস। ছবি: এপি।

বৈঠকের ফাঁকে জার্মান চ্যান্সেলার অ্যাঞ্জেলা মের্কেলের সঙ্গে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস। ছবি: এপি।

‘ইউরো’র ভাগ্যকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা। এক দিকে, অসি শানিয়ে গ্রিস। অন্য দিকে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ান (ইইউ), আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ)-এর মতো ঋণদাতারা। এ পালায়, কে ইংরেজ, কে সিরাজ, কে-ই বা মীরজাফর তা অবশ্য বোঝা কঠিন। যা বোঝা যাচ্ছে, চলতি সপ্তাহের মধ্যেই একটা হেস্তনেস্ত হতে চলেছে। তবে বুধবার থেকে ব্রাসেলস-এর প্রান্তরে লাগাতার যে সমঝোতা-যুদ্ধ চলছে তাতে এখনও পর্যন্ত খুব একটা আশা দেখছে কোনও পক্ষই। দোষের দায় ছোড়াছুড়ি ছাড়া কাজের কাজ বিশেষ কিছুই হয়নি। যদিও গ্রিসের সঙ্গে এই আলোচনায় ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে (ইসিবি)-র প্রধান মারিও দ্রাগি, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রধান জন ক্লড ইয়ুঙ্কা, ইউরো গ্রুপের প্রধান ডিসেলব্লুম, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল, আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টিনা লাগার্ডি-র মতো হেভিওয়েটরা রয়েছেন। রাত বাড়ছে, বাড়ছে বার্তালাপের সময়সীমাও।

বুধবার অবশ্য বেশ তৈরি হয়েই ময়দানে নেমেছিলেন গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি সিপ্রাস। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ১১ পাতার নতুন সমঝোতার শর্ত। কিন্তু সেই শর্ত আশ্বস্ত করতে পারেনি ইউরো দেশগুলির অর্থমন্ত্রী, ইউরোপিয়ান কমিশন, ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক এবং আইএমএফ-এর প্রতিনিধিদের। আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আশ্বাস ছাড়া ব্রাসেলস বৈঠকের নিটফল আপাতত শূন্য।

কিন্তু, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, জানুয়ারিতে সরিজা দল গ্রিসের নির্বাচন জেতার পরে এ আশঙ্কা অনেকেই করেছিলেন। অতি-বামপন্থী সরিজা-র প্রতিশ্রুতিই ছিল পাঁচ বছরের তীব্র আর্থিক সঙ্কটে জর্জর গ্রিসের আম নাগরিককে সুরাহা দেওয়ার। আইএমএফ আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের চাপিয়ে দেওয়া শর্তাবলী বিনাযুদ্ধে না মানার। এবং প্রয়োজনে ‘ইউরো’ মুদ্রাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার। বঙ্গ থেকে ব্রিটেন— ধরাধামের আনাচেকানাচে আনন্দোল্লাসে মেতেছিলেন বামপন্থীরা। প্রমাদ গুণেছিলেন গ্রিসের ঋণদাতারা। আশঙ্কা ছিল, সরাসরি ইউরো থেকে বেরিয়ে যাবে গ্রিস। না, সে আশঙ্কা অবশ্য সত্যি হয়নি। আলোচনায় বসেছে গ্রিস। তবে ক্রমেই তিক্ত হয়েছে আলোচনার পরিবেশ।

আইএমএফ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নানা দেশ মিলিয়ে গ্রিসের মোট ঋণ তার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি)-এর ১৮০ শতাংশ। কিন্তু গ্রিসের আবার ঋণ দরকার। গ্রিসের অর্থনীতির হাঁড়ির যা হাল তাতে খোলা বাজারে সে ঋণ মিলবে না। অতএব আইএমএফের মতো সংস্থা বা জার্মানির মতো দেশই ভরসা। তারা ঋণ দিতেও রাজি। ঋণের পরিমাণও স্থির, ৭২০ কোটি ইউরো। কিন্তু ঋণ নিতে গেলে মানতে হবে শর্ত। ঋণদাতাদের মতে এই শর্ত মানলেই আগামী দিনে গ্রিস ঋণ শোধের অবস্থায় পৌঁছবে। কিন্তু এর আগের ঋণের শর্ত মানতে গিয়েই কালঘাম ছুটেছে গ্রিসের। নাভিশ্বাস উঠেছে আম-জনতার। বৃদ্ধি দূর অস্ত্, উল্টে ২০১০ থেকে হিসেব করলে জিডিপি কমেছে ২৫ শতাংশ।

জানুয়ারিতেই গ্রিসের এই ঋণ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিপ্রাস ক্ষমতায় আসার পরে ঋণদাতারা তা পিছিয়ে দেন আরও চার মাস। যাতে শর্তগুলি নিয়ে আরও আলোচনা করা যায়। ৩০ জুনের মধ্যে শর্ত মেনে সেই ঋণ মেলার কথা। কিন্তু এখন অবস্থা বলছে সে বড় দুরাশা। কিন্তু সরিজা দলটি তো এই শর্তের বিরোধিতা করে, সাধারণ নাগরিকের জীবনযাপনের কষ্ট লাঘবের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছে। শর্ত মানা তো সিপ্রাসের কাছে রাজনৈতিক আত্মহত্যার সামিল। সঙ্গে গোদের উপরে বিষ ফোঁড়ার মতো ৩০ জুনের মধ্যেই আইএমএফ থেকে নেওয়া আগের ঋণের এক কিস্তি শোধ করতে হবে গ্রিসকে। যার মূল্য ১৬০ কোটি ইউরো। যাও প্রায় অসম্ভব। দু’দিকের চাপেই যখন অর্থনীতির শ্বাস উঠছে তখন গ্রিসের ব্যাঙ্কে আবার ইউরো তোলার ধুম লেগেছে। কয়েক দিন ধরেই বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্কের তলবিল দ্রুত ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ইসিবির সাহায্যে প্রতি দিন পরিত্রাণ মিললেও ৩০ জুনের পরে তা-ও জুটবে না।

এই অবস্থায়ও সিপ্রাসের পক্ষে শর্তগুলি মানা দুরূহ। মতভেদ ঘোরতর। যেমন, বড় গোলযোগ গ্রিসের পেনশন খাতকে নিয়ে। গ্রিস পেনশনের পিছনে জিডিপি-র প্রায় এক শতাংশ ব্যয় করে। এই ব্যয় প্রায় ১৫ শতাংশ কমাতে চাপ দিচ্ছে ঋণদাতারা। কিন্তু পেনশনের উপরে গ্রিসের বড় অংশের মানুষ নির্ভরশীল। শুধু প্রবীণরা নন, তাঁদের কর্মহীন সন্তানদের সংসারও তো ওই অর্থেই চলছে। যাতে হাত দিতে তীব্র আপত্তি সিপ্রাস-এর। তাই বুধবারের বৈঠকে অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে ৬৭ বছর করা, পেনশন ফান্ডে কর্মচারীদের বিনিয়োগের অংশ বাড়ানোর মতো প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তা বাতিল করে দিয়েছেন ঋণদাতারা। গ্রিসের আশা ছিল, তাদের প্রস্তাব মানলে আগামী ২০১৮-এ বাজেটে লাভের খাতায় (আয়, ব্যয়ের পার্থক্য) যে অঙ্ক থাকত তা জিডিপি-র ৩.৫ শতাংশ মতো হত। কমত ঋণ ও জিডিপি-র অনুপাতও। কিন্তু আইএমএফের ধারণা, শর্তগুলি না মানলে গ্রিসের আর্থিক বৃদ্ধির যা হাল হবে তাতে এই অঙ্ক অবাস্তব।

সমস্যা রয়েছে কর ব্যবস্থাকে নিয়েও। এমনিতেই গ্রিসের কর ব্যবস্থা বেশ জটিল। ফলে নানা ভাবে কর ফাঁকি চলে বলে ঋণদাতাদের অভিযোগ। একই সঙ্গে যুক্তমূল্য কর (ভ্যাট) বাড়ানোরও দাবি করে আসছেন তাঁরা। তেতো বড়ি গেলার মতো সিপ্রাস-এর বুধবারের প্রস্তাবে কয়েকটি ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়ানোর কথা মেনে নেওয়া হয়েছিল। বলা ছিল ব্যবসায়ী ও ধনীদের উপরে আরও নতুন কর বসানোর কথা। কিন্তু তাতে যে হারে কর বাড়বে আর তার থেকে যে পরিমাণ আয়ের কথা বলা হয়েছে তা অসম্ভব বলেই ঋণদাতাদের মত। তা ছাড়া আইএমএফ-এর মতে ব্যবসায়ী ও ধনীদের উপরে নতুন কর বসলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। নেই কর ফাঁকি রোধের ব্যবস্থাও। অতএব এ প্রস্তাবও বাতিল।

প্রধান মতভেদের জায়গা

গ্রিসের দাবি ছিল ঋণ শোধের সময়সীমাকে আরও খানিকটা বাড়িয়ে দেওয়ার। ঋণদাতারা তাতে নিমরাজি ছিলেন। কিন্তু আগে শর্ত মেনে মূল ঋণটি নিলে তার পরে সে ভাবনা। শ্রম আইনের সংস্কার নিয়ে দু’পক্ষের মত ধারে কাছেও নেই। আর সরকারি ক্ষেত্রে মাইনে কমানোর ভাবনা সিপ্রাসের কাছে নৈবনৈব চ। এই অবস্থায় আলোচনার এই ম্যারাথনে আদৌ ফল মিলবে কি না তা নিয়েই সংশয় ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।

কোনও সমঝোতার জন্য পারস্পরিক বিশ্বাস দরকার। দরকার একে অপরের মতাদর্শের প্রতি সহানুভুতি। কিন্তু গ্রিস সরকার আর ঋণদাতাদের মধ্যে সেই বিশ্বাসটাই হারিয়ে গিয়েছে। একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখছে তারা। গ্রিসের গণমাধ্যমে ক্রিস্টিন লাগার্ডিকে ‘ক্রিমিনাল’ বলে প্রচার চালিয়েছিলেন সরিজা দলের বেশ কয়েক জন মন্ত্রী। আলোচনার টেবিলে তাই নিজের ‘ক্রিমিনাল’ পরিচয় দিয়েই আলোচনা শুরু করেন ক্রিস্টিন। ঠাট্টার ছলে হলেও পারস্পরিক সম্পর্কের খানিক আভাস এতে মেলে। আলোচনায় এই লাগার্ডিই একে একে বাতিল করে দেন সিপ্রাসের নতুন প্রস্তাবগুলি। জানান, এই প্রস্তাবগুলি গ্রিসের অর্থনীতিকে পিছিয়ে দেবে। এতে আর্থিক বৃদ্ধি ধাক্কা খাবে। ঋণ শোধের অবস্থায় পৌঁছতেই পারবে না গ্রিস। বরং শর্তগুলি মানলে প্রাথমিক ভাবে অসুবিধায় পড়লেও গ্রিসের উন্নতির পথে ফিরবে।

কিন্তু সমস্যা হল এর আগে তেতো বড়ি গিলেও গ্রিসের অবস্থার উন্নতি হয়নি। সাম্প্রতিক হিসেব বলছে, গ্রিসে প্রতি দিন ঝাঁপ ফেলছে ৫৯টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। কর্মহীনের হার হুহু করে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশে। এই অবস্থায় আম-জনতাকে আরও তেতো বড়ি গেলানো প্রায় অসম্ভব। সিপ্রাসের দল নীতিগত ভাবেও তো এর বিরোধী। এমনকী সিপ্রাস যে ১১ পাতার প্রস্তাব নিয়ে গেলেন তার বিরুদ্ধে নিজের দলেরই বেশ কিছু লোক মুখ খুলেছে। আথেন্স-এর রাজপথে এর মধ্যেই বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।

কিন্তু ‘ইউরো’ মুদ্রাব্যবস্থা থেকে বেরোলেই কি স্বস্তি মিলবে গ্রিসের? বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, না। ইউরো-য় গ্রিসের যে ঋণ আছে তার দাম গ্রিসের মুদ্রায় (ড্রাকমা) হুহু করে বাড়বে। কারণ, হুহু করে দাম পড়বে নতুন ড্রাকমার। বেসামাল হয়ে পড়বে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা। তীব্র মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কাও রয়েছে। তাই সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা বলছে, গ্রিসের ৬৭ শতাংশ নাগরিক এখনই ‘ইউরো’ থেকে বের হতে চান না। অন্য দিকে, ইউরো প্রাথমিক ধাক্কা সামলানোর অবস্থায় থাকলেও ভাবমূর্তি বেশ আঘাত পাবে। ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়লে গ্রিসের মতো অন্য দেশও বেরিয়ে যেতে পারে। সব মিলিয়ে ছবিটি সুখকর নয়। আবার অন্য রাজনৈতিক ভয়ও রয়েছে। সিপ্রাস আর পুতিনের সাম্প্রতিক মাখামাখি ইউরোপের অনেক নেতাই সন্দেহের চোখে দেখছেন। ভয় করছেন, ইউরো ভেঙে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হতে পারে গ্রিস। একই পথ ধরতে পারে অন্য দেশগুলিও। ইউরোপে আবার নেমে আসতে পারে চার্চিল কথিত ‘আয়রন কার্টেন’।

european union imf greece euro greece vs european union ratnanka bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy