এ ভাবেই রাস্তায় পড়ে রয়েছে নিথর দেহ। ইস্তানবুলে। ছবি: এএফপি।
ভ্রমণপ্রিয় বাঙালির ছুটির ঠিকানা দেশের সীমানা পার করে ফেলেছে বেশ কিছু বছর আগেই। কিছু দিন আগেও জনপ্রিয় ও সহজ বিদেশ ভ্রমণে তাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার নামই আগে আসত। তবে এদের পাশাপাশিই মধ্যবিত্ত বাঙালির পকেট-বন্ধু সহজ বিদেশযাত্রার তালিকায় ধীরে ধীরে দিব্যি জায়গা করে নিয়েছে তুরস্কও। অপূর্ব নিসর্গ, মনোরম আবহাওয়া, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পর্যটক টানার কারণ হয়ে উঠেছে সহজ ভিসা এবং সস্তায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা।
কিন্তু গত দু-এক বছর ধরেই পর্যটকদের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে তুরস্ক। এর অন্যতম একটি কারণ, আইএস অধ্যুষিত সিরিয়ার গা-ঘেঁষে অবস্থান। নিয়মিত অশান্তির জেরে পর্যটনের আনন্দ প্রায়ই বদলে যাচ্ছে সংঘাতের আতঙ্কে। তথ্য বলছে, গত এক বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে আটটি জঙ্গিহানা ঘটেছে তুরস্কে। তাই বেশ কিছু দিন ধরেই পর্যটকদের আকর্ষণ করছে অরহান পামুকের দেশের প্রতি।
‘ট্র্যাভেল এজেন্টস ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া’-র পূর্বাঞ্চলীয় শাখার চেয়ারম্যান অনিল পঞ্জাবি জানাচ্ছেন, বাঙালিদের তুরস্ক-ভিসার চাহিদা প্রায় ৪৫ শতাংশ কমে গিয়েছে গত এক বছরে। জুনের শেষে ইস্তানবুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দরে জঙ্গিহানার পরেই বাতিল হয়েছে আরও বেশ
কিছু ভিসার আবেদন। সন্ত্রাস বন্ধ না-হলে এই ধারা চলবে বলেই মনে করছেন অনিল।
লাগাতার সন্ত্রাস, সংঘাত ও রক্তপাতের মুখে বাঙালি-পর্যটনের এই ধাক্কা খাওয়া ছবিটাই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল শহরের ভ্রমণ সংস্থাগুলির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে। একটি সংস্থার তরফে প্রশান্ত দাস জানালেন, গত ছ’সাত বছর ধরে প্রতি বছর শ’খানেক পর্যটক নিয়ে তুরস্ক ভ্রমণের আয়োজন করছেন তাঁরা। সাধারণের মধ্যে ভালই উৎসাহ তৈরি হয়েছিল। তবে গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে এ বছরে তাঁদের সংস্থার তুরস্কযাত্রীর সংখ্যা। জানালেন, বছরে দু’বার তুরস্ক-গ্রিস ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন তাঁরা। এপ্রিলে ও অক্টোবরে। এ বছর এপ্রিলে
মাত্র ১৬ জন বাঙালি ছিলেন সেই যাত্রায়। অক্টোবরে দু’টি দলের যাওয়ার কথা থাকলেও, একটি দল বুকিং বাতিল করে দিয়েছে। প্রশান্তবাবুর আশঙ্কা, তুরস্কে শনিবারের সেনা-সন্ত্রাসের পরে আরও কমতে পারে পর্যটকের সংখ্যা।
বিদেশযাত্রা আয়োজনকারী অন্যতম বড় ভ্রমণ সংস্থাটির তরফে টমাস জানালেন, সারা দেশ থেকেই তুরস্ক ভ্রমণের চাহিদা বেশ বেড়েছিল গত ছ’সাত বছরে। তাঁদের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে তুরস্কে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা। তার মধ্যে বড় অংশই বাঙালি। তবে গত বছরের একাধিক হামলার পর থেকে অনেক পর্যটকই তুরস্ক এড়িয়ে স্পেন, ইতালি বা জর্ডন চলে যাচ্ছেন।
২৩ বছর ধরে বাঙালি পর্যটকদের জন্য ভ্রমণ আয়োজন করছেন ভাস্কর সেন। শেক্সপীয়ার সরণীর দফতর থেকে জানালেন, সস্তায় ও সহজে যে যে দেশে ভ্রমণ আয়োজন করা যায়, তাদের মধ্যে অন্যতম তুরস্ক। গত ছ’বছর ধরে বাঙালি পর্যটকদের তুরস্ক নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু গত বছর থেকেই ভাটা পড়েছে তুরস্ক ভ্রমণে। এই বছর তো পরিকল্পনার পরেও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে তুরস্ক যাত্রা। পর্যটকদের নিরাপত্তার ঝুঁকি নিতে রাজি নন তাঁরা।
শনিবার সকালের ব্রেকিং নিউজ দেখেই ঘনঘন ফোন আসতে শুরু করেছে বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থার দফতরগুলিতে। প্রশ্ন একটাই, তুরস্কে বেড়াতে যাওয়া কতটা নিরাপদ এই বছর। কিন্তু এ ভাবে আগে থেকে নিরাপত্তার কথা বলা যায় না বলেই জানালেন একটি ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে যুক্ত নন্দিনী সেন। তাঁর কথায় ‘‘সাম্প্রতিক ঘটনাগুলিই বলে দিচ্ছে, সন্ত্রাসের আর দেশ-কাল-সীমানা নেই। তাই কোথায় কবে কী হবে, সেই ভেবে নিরাপদ বেড়ানোর পরিকল্পনা করা মুশকিল।’’
কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা থেকে নন্দিনী জানালেন, গত কয়েক বছরে মালয়েশিয়া, তুরস্ক, গ্রিসের মতো দেশগুলির অর্থনীতি ঢেলে সাজছিল পর্যটনের হাত ধরে। এই সুযোগে বড় সংখ্যায় মধ্যবিত্ত বাঙালি এ সব দেশে পাড়ি জমাতে পারছিলেন। সাম্প্রতিক অপ্রীতিকর ঘটনাগুলি সেই ধারাকেই ব্যাহত করল। তবে অশান্তির ভয়ে কোনও দিনই ঘরে বসে থাকেনি বাঙালি। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না বলেই মনে করছেন নন্দিনী।
ভ্রমণপ্রিয় বাঙালির একটা বড় অংশ যেমন জানাচ্ছেন, বেড়াতে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য আনন্দ। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আনন্দ উপভোগ হয় না। ঠিক তেমনই, সব কিছুর পরেও আর এক দল বলছেন, সন্ত্রাসের ছায়া নিজের শহরেও নেমে আসতে পারে যখন তখন। বেড়াতে যাওয়া বাতিল করলেই তো নিরাপত্তা বেড়ে যায় না!
মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় বাড়ছে দোলাচল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy